মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম

খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা এবং অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের সপ্তম পর্বে রইলো খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম'র  বীরত্বগাঁথা)

মুক্তিযুদ্ধে খালেদ মোশাররফ ছিলেন ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্সের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীরউত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ৭। 

১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ মেজর খালেদ মোশাররফকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুমিল্লার চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। ২২ মার্চ নিজ পরিবারকে ঢাকায় রেখে কুমিল্লায় চলে যান খালেদ মোশাররফ। কুমিল্লায় ইউনিটে যোগ দেওয়ার পর তিনি দেখলেন সৈন্যরা বেশ উদ্বিগ্ন। সৈন্যদের উদ্বিগ্ন হওয়ার অন্যতম কারণ হলো- পাকিস্তানি বাহিনীর পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন এবং গোলন্দাজ ইউনিট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে মেশিনগান লাগিয়ে অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তানি অফিসাররা বললেন, এটি ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তার স্বার্থেই। এই ধরনের কার্যাবলীতে ইস্ট বেঙ্গলের সৈন্যদের মধ্যে বেশ অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল। মেজর খালেদ মোশাররফ তখন সৈন্যদের শান্ত করতে আত্মরক্ষার্থে প্রহরী দ্বিগুণ করতে নির্দেশ দেন। ২৪ মার্চ সকাল ৭টার দিকে মেজর খালেদ মোশাররফ চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত খানের কাছে নিয়মিত রিপোর্ট প্রদান করেন। এদিন সকাল ১০টার দিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত খান মেজর খালেদ মোশাররফকে ডেকে বলেন, 'শমসেরনগরে নকশালবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তোমাকে তাদের বিরুদ্ধে একটি কোম্পানি নিয়ে অ্যাকশন চালাতে হবে।'

খালেদ মোশাররফ পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পারলেন। তিনি জবাবে বললেন, 'মাত্র দুদিন হলো আমি এখানে এসেছি। আমার দায়িত্ব কেবল বুঝে নিচ্ছি, এমন সময় আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া আপনার জন্য ভুল হবে।' কিন্তু কর্নেল খিজির হায়াত খান তার কথায় অটল রইলেন। শেষপর্যন্ত ব্রিগেড কমান্ডার ইকবাল শফির অনুরোধে খালেদ মোশাররফকে শমসেরনগর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো।

মেজর খালেদ মোশাররফ তখন বলেন, 'যেহেতু আমাকে পাঠানো হচ্ছে, সেহেতু আমাকে একটি কোম্পানি দিলে হবে না। আমার সঙ্গে এক কোম্পানির চেয়ে বেশি সৈন্য লাগবে। হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য শক্তিশালী ওয়্যারলেস সেট দেওয়া হোক। এ ছাড়া, যেহেতু বেশ দূরে যাচ্ছি, আমার ট্রুপসের জন্য স্বয়ংক্রিয় ভারী ও হালকা অস্ত্র, মর্টার এবং যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক।' প্রথমে ব্রিগেডিয়ার শফি আপত্তি করলেও মেজর খালেদ মোশাররফের অনড় মনোভাব দেখে কর্নেল খিজির হায়াত খানকে নির্দেশ দিলেন তাকে যাবতীয় সাহায্য করার জন্য।

অনুমতি পাওয়ার পর মেজর খালেদ মোশাররফ ব্যাটেলিয়নের অ্যাডজুস্ট্যান্ট ক্যাপ্টেন গাফফারকে নির্দেশ দিলেন সমগ্র ব্যাটেলিয়ন থেকে বেছে বেছে ২৫০ জন সৈন্যকে আলফা কোম্পানিতে একত্রিত করার। একইসঙ্গে ব্যাটালিয়নের যতো ভারী অস্ত্র আছে সব নিয়ে নিতে এবং গোলাবারুদ এমন পরিমাণ নিতে যেন টানা এক মাস যুদ্ধ করা যায়। ব্রিগেড থেকে ২৬টি গাড়ি দেওয়া হয়েছিল। এই গাড়িতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এসময় প্রতিটি দৃশ্যই নিজ চোখে দেখেছিলেন কর্নেল খিজির হায়াত খান এবং ব্রিগেড স্টাফরা। ২৪ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তারা শমসেরনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। যাওয়ার আগে ক্যাপ্টেন মতিনকে খালেদ মোশাররফ বললেন, 'আমি চলে যাচ্ছি বলে ঘাবড়াবার কিছু নেই। এখন তুমিই সিনিয়র। যদি কোনো অঘটন ঘটে তাহলে চতুর্থ বেঙ্গলের বাকি ট্রুপসের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করবে, প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসবে এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।  

রাত আড়াইটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে কাছাকাছি এলে তারা দেখলেন রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া। প্রতিটি জায়গায় নেমে ব্যারিকেড সরিয়ে শহরে এসে পৌঁছালে দেখা গেল, ছাত্র জনতা রাস্তায় শুয়ে প্রতিবাদ করছে। মেজর খালেদ মোশাররফ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, 'আজ বহু জায়গায় পাঞ্জাবি সৈন্যরা ছাত্র জনতার মিছিলে গুলি চালিয়েছে। এজন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আদেশে সেনাবাহিনীর চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আপনাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু আমরা আপনাদের যেতে দিব না।' দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তার কয়েক ঘণ্টা পর একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানকারী চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানির কমান্ডার মেজর শাফায়েত জামিল। তিনিও স্থানীয় ছাত্র ও জনতাকে বোঝান। একপর্যায়ে ২৫ মার্চ সকাল ৭টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে দুপুর ২টার দিকে শমসেরনগর পৌঁছান।

২৫ মার্চ রাতে পরিস্থিতি খানিকটা ঘোলাটে মনে হল মেজর খালেদ মোশাররফের। কারণ এখানে নকশালপন্থীদের কোনো উপদ্রব নেই। সকল চা বাগানে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানিরা ঢাকায় ফিরে গেছে। তিনি পুরোপুরিভাবে বুঝলেন তাকে কৌশল করে এখানে পাঠানো হয়েছে। সারাদিন হেড কোয়ার্টারে বার বার যোগাযোগ করেও তিনি সংযোগ পাননি। ২৬ মার্চ বিকেলে তিনি স্থানীয় কারও কারও কাছে শুনলেন, ঢাকায় গোলাগুলি হয়েছে, বহু মানুষ মারা গেছে। তাও আবছা সংবাদের মতো। এরপর ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি মেজর শাফায়েত জামিলের কাছে একে একে ঢাকায় চালানো পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডবলীলা এবং নৃশংসতার ঘটনা শুনেন। বেশ কয়েক ঘণ্টা ভাবার পর মেজর খালেদ মোশাররফ স্বাধীনতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং লেফটেন্যান্ট মাহবুবকে বললেন, 'আমরা আর কেউ পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করব না, এখন থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ শুরু। সব সৈনিকদের তৈরি হতে বলো।'

এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকার দিকে রওয়ানা হয়ে যাবেন এবং তাকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একত্রিত করতে হবে। তিনি ওয়ারলেসে মেজর শাফায়েত জামিলের সঙ্গে কথা বলে জানান, কুমিল্লার রাস্তার দিকে খেয়াল রাখতে এবং তারা শিগগির ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছে যাবেন। ভোর ৫টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকা কর্নেল খিজির হায়ার খানের সঙ্গে কথা হয় খালেদ মোশাররফের। তিনি বলেন, 'পরিস্থিতি সব স্বাভাবিক'। এরইমধ্যে মেজর শাফায়েত জামিল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'তারা কোথায় এবং কেন তাদের আসতে এতো দেরি হচ্ছে!' এসময় মেজর খালেদ মোশাররফ খিজির হায়াত খানসহ সব পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেপ্তার করার আদেশ দেন। ২৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। তখন মেজর খালেদ মোশাররফ কুমিল্লা অঞ্চলে অবস্থানরত সব বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় মেঘনা নদীকে উত্তরে রেখে পশ্চিম প্রতিরক্ষা লাইন তৈরি করে, দক্ষিণে ময়নামতি সীমান্ত পর্যন্ত মুক্ত করে প্রতিরক্ষা লাইন তৈরি করা এবং দক্ষিণে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। অন্যদিকে, উত্তর-পূর্বে মৌলভীবাজার থেকে সিলেট পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে সিলেটে একটি ঘাঁটি গড়ে তোলা।   

এই পরিপ্রেক্ষিতে মেজর খালেদ মোশাররফ প্রথমে ভৈরববাজারে ২ কোম্পানি সৈন্য পাঠিয়ে দেন। আরেকটি পার্টিকে তিনি কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে বলেন। মেঘনার পূর্ব পাড়ে একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চতুর্দিকে এবং তিতাস নদীর চতুর্দিকে একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরির ব্যবস্থা করেন। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাকে সিলেটের দিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মেজর খালেদ মোশাররফের ঘোষণা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক রকিব পুলিশ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সব জেলা ও মহকুমাগুলোতে জানান যে, 'মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত করেছে।' একইসঙ্গে খালেদ মোশাররফ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 

মুক্তিযুদ্ধের ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ঐতিহাসিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। এই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সেই বৈঠকে মেজর খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন, 'আমাদের যে অস্ত্র আছে, এই অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না। আমাদের অতিসত্বর বন্ধু রাষ্ট্র বা অন্য কোথাও থেকে অস্ত্রের ব্যবস্থা করতে হবে এবং একইসঙ্গে কোনো নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সরকার গঠন করা হোক, যেন আমরা বহির্বিশ্বের দ্রুত সহযোগিতা পাই।'

এর কয়েকদিন পর ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের জুলাই মাসে ব্রিগেড গঠন করা হলে চতুর্থ, নবম এবং দশম ইস্ট বেঙ্গলকে নিয়ে গঠিত হয় কে ফোর্স ব্রিগেড। একই মাসে সেক্টর গঠন করা হলে মেজর খালেদ মোশাররফকে ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার করা হয়। 

মুক্তিযুদ্ধে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে থাকা ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা ছিল সবচেয়ে বেশি। নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনী মিলে এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৩ হাজার।

২ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল নোয়াখালী জেলা, কুমিল্লা জেলার আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত এবং ফরিদপুর ও ঢাকার অংশবিশেষ। ২ নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল ত্রিপুরার মেলাঘরে। ২ নম্বর সেক্টরে মোট সাব সেক্টর ছিল ৬টি, যথা গঙ্গাসাগর, মন্দভাগ, সালদা নদী, মতিনগর, নির্ভয়পুর ও রাজনগর।

২ নম্বর সেক্টরের অধীনেই গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম এবং সর্ববৃহৎ ফিল্ড হাসপাতাল। মুক্তিযুদ্ধের মে মাসে আগরতলার সোনামুড়ায়  বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ার পেছনে মেজর খালেদ মোশাররফের অসামান্য অবদান ছিল। পরবর্তীতে এই হাসপাতাল বিশ্রামগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়। 

মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টরের বিখ্যাত সব অপারেশনে নির্দেশনা দিয়েছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। এরমধ্যে বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধ, শালদা নদীর যুদ্ধ, মন্দভাগ অপারেশন, কাশিমপুর রেলব্রিজ ধ্বংস, শাহপুরের যুদ্ধ, শাসিয়ালী ও শাহরাস্তির চিতোষীর যুদ্ধ, চরশোলাদী গ্রামের যুদ্ধ ও ছাতুরার অ্যামবুশসহ অসংখ্য যুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকায় দুর্ধর্ষ গেরিলা আক্রমণের জন্য তৈরি ঢাকা প্লাটুন বা ক্র্যাক প্লাটুন গড়ে উঠেছিলো মেজর খালেদ মোশাররফের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নির্দেশে এবং অবদানে। ক্র্যাক প্লাটুন গড়ে উঠেছিল এমন তরুণদের নিয়ে, যারা অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং ঢাকা শহরকে হাতের তালুর মতোই চিনে। খালেদ মোশাররফের নির্দেশে আরবান গেরিলা যুদ্ধের জন্য বিশেষায়িতভাবে তৈরি করা হয়েছিল এই দলটিকে।

খালেদ মোশাররফ চেয়েছিলেন এই সদস্যরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকা বিদেশি সাংবাদিক ও অতিথিদের ঢাকা শহরের অবস্থা যে স্বাভাবিক নয়, তা জানান দেবে। আর এজন্য শহরের আশপাশে বেশকিছু গ্রেনেড ও গুলি ছুঁড়বে। কিন্তু এই তরুণরা ঢাকায় এসে ৯ জুন সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করে এবং বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে। যা ছিল অকল্পনীয় একটি কাজ। এদিন সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে ঢাকার খবর পেয়ে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন, 'দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল!' সেই থেকেই ক্র্যাক প্লাটুন নামে পরিচিত হয়ে উঠে ঢাকা প্লাটুন।

মুক্তিযুদ্ধের ২৩ অক্টোবর মেজর খালেদ মোশাররফের মাথায় গুলি লাগায় তিনি গুরুতর আহত হন। পরবর্তীতে তাকে ভারতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তার পরিবর্তে ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার করা হয় মেজর এ টি এম হায়দারকে।

খালেদ মোশাররফের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১ নভেম্বর জামালপুরের ইসলামপুর থানার মোশাররফগঞ্জে। কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে মেট্রিক এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান। ১৯৫৭ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভের পর ৮ বছর বিভিন্ন সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। এরপর কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর তিনি মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি ডিগ্রি পাওয়ার পরে তাকে ব্রিগেড মেজর হিসেবে খারিয়াতে ৫৭ ব্রিগেডে নিয়োগ দেওয়া হয়। জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে সেনা প্রশিক্ষণে যাওয়ার কথা থাকলেও ১৯৭০ সালের মার্চে তাকে ঢাকায় বদলি করা হয়। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। স্বাধীনতার পর খালেদ মোশাররফ ঢাকা সেনা সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হবার পর ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন খালেদ মোশাররফ। সেসময় সেনাপ্রধান হয়েছিলেন তিনি। ৩ দিন পর আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন খালেদ মোশাররফ।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র নবম এবং দশম খণ্ড।

বাংলাপিডিয়া

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ২ 

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Sweeping changes in constitution

Expanding the fundamental rights to include food, clothing, shelter, education, internet and vote, the Constitution Reform Commission proposes to replace nationalism, socialism and secularism with equality, human dignity, social justice and pluralism as fundamental principles of state policy.

2h ago