কেরানীগঞ্জে এক নৃশংস গণহত্যার আখ্যান

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় শোষণ মুক্তির মন্ত্রে উদ্দীপ্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের রেশ তখনো কাটেনি। শহর থেকে গ্রামের পথে মানুষের ঢল। নিরাপদ মনে করে যাদের মধ্যে অনেকেই আশ্রয় নেন বুড়িগঙ্গার ওপারের কেরানীগঞ্জে।

কিন্তু অপারেশন সার্চলাইটের এক সপ্তাহের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আরেকটি পরিকল্পিত গণহত্যা চালায় কেরানীগঞ্জে। যা জিঞ্জিরা গণহত্যা নামেও পরিচিত। অনেকের মতে, ২৫ মার্চের পর অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকার আশপাশের এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেসব পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে, তার মধ্যে কেরানীগঞ্জের গণহত্যাই প্রথম।

একাত্তরের ২ এপ্রিল কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, শুভাঢ্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নজুড়ে সংঘটিত ওই হত্যাযজ্ঞে নিহত হন কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, এ সংক্রান্ত লেখাপত্র ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেদিন বুড়িগঙ্গা নদীতে গানবোটে করে টহল দিচ্ছিল পাকিস্তানি সেনারা। মানুষ যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, তার জন্য বিলের চারপাশে লাগানো হয়েছিল কাঁটাতারের বেড়া। সেদিন ভোররাতে আকস্মিক আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় ওদিক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আশ্রিত ও স্থানীয়দের অনেকে সেই বেড়ায় আটকা পড়েন। তাদের একে একে গুলি করে মারা হয়। প্রায় দুপুর পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে চালানো হয় ব্যাপক লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ।

সে সময় কেরানীগঞ্জের অনেক বাসিন্দা ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। এছাড়া আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবেও এর পরিচিতি ছিল। অপরেশন সার্চলাইটের পর কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেওয়া জাতীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, শাজাহান সিরাজ, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আ স ম আবদুর রবসহ আরও অনেকে।

এছাড়া যে প্রেক্ষাপটে কেরানীগঞ্জে গণহত্যার পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল, তার খানিকটা ধারণা পাওয়া যায় ঢাকায় তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তথ্য কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের লেখা 'উইটনেস টু সারেন্ডার' শীর্ষক গ্রন্থ থেকে।

১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সঙ্গে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত সিদ্দিক সালিক ওই গ্রন্থে জানান, তিনি যখন ঢাকার সামরিক আইন প্রশাসকের সদর অফিসে দায়িত্বরত ছিলেন। তখন পাকিস্তানপন্থী আস্থাভাজন কিছু বাঙালি তাদের নিয়মিত ঢাকার তথ্য সরবরাহ করতেন। তেমনই একজন বাঙালি পাকিস্তানি সেনা সদরে এসে খবর দেয় যে, কেরানীগঞ্জে কয়েক হাজার বিদ্রোহী বাঙালি ইপিআর ও পুলিশ সদস্য সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সিদ্দিক সালিকের ভাষ্য অনুসারে, ১ এপ্রিল এই খবর পাওয়ার পর সেটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেদিনই সেনা সদর কেরানীগঞ্জে একটি চূড়ান্ত আঘাতের সিদ্ধান্ত নেয়।

সেদিনের ওই গণহত্যার প্রসঙ্গে কথা হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা জেলা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করা কেরানীগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মহসীন মন্টুর সঙ্গে। সেসময় তিনি সেখানেই অবস্থান করছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের আরও অনেক জাতীয় ও প্রভাবশালী ছাত্রনেতারা।

মোস্তফা মহসীন মন্টু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা থেকে পালিয়ে গিয়ে আমরা তখন কেরানীগঞ্জে সবাইকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যেই আমাদের কাছে খবর আসলো যে, পাকিস্তানি বাহিনী কেরানীগঞ্জে আক্রমণ করতে পারে। এই খবর পেয়ে বুড়িগঙ্গায় যত নৌকা ছিল, তার সবগুলো আমরা বন্ধ করে দিলাম। মাঝিদের বলে দিলাম, এই এলাকার ভেতর যেন কোনো নৌকা না থাকে। আমাদের ধারণা ছিল ওরা (পাকিস্তানি বাহিনী) হয়তো নৌকা নিয়েই পার হবে।'

মন্টু বলতে থাকেন, 'এর মধ্যে লালকুঠি এলাকা থেকে আমাদের এক ছেলে এসে জানালো, সদরঘাট থেকে সেখানে কয়েকটি লঞ্চ এনে রাখা হয়েছে। মিডফোর্ড হাসপাতালের এক ব্রাদার জানায়, আর্মির লোকেরা হাসপাতালের উপরের তলাটা দখলে নিয়ে নিয়েছে। তখন আমরা আক্রমণের ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম।'

পরদিন ফজরের আজানের সময় থেকেই শুরু হয় আক্রমণ। মন্টু বলেন, 'ভোররাতের দিকে জিঞ্জিরার দিকে লঞ্চ আসতে শুরু করলে আমাদের এক ছেলে ওই লঞ্চ লক্ষ্য করে গুলি করে। পাল্টা জবাব আসতে দেরি হয়নি। তখন আমরা যা বোঝার বুঝে গেলাম। নদীর ধার থেকে শুরু হলো মর্টার শেলিং। মেশিনগানের গুলিতে পাখির মতো মানুষ মরল।'

মন্টু জানান, আক্রমণের আভাস পেয়ে আগের দিনই মাইকিং করে স্থানীয়দের সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন তারা। কিন্তু তীব্র আক্রমণের মুখে সবকিছু খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। তিনি বলেন, 'একেবারে ছিন্নভিন্ন অবস্থা তখন। প্রতিরোধের কোনো উপায়ই ছিল না। বিলের ভেতর কাঁটাতার দেওয়া ছিল। তখন কেরানীগঞ্জের খালগুলো ছিল শুকনো। ভয়ার্ত মানুষগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে এসে ওই খালের মধ্যে, বিলের মধ্যে গুলি করে মারা হয়।'  

মন্টুর ধারণা, সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অন্তত ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার মানুষ মারা পড়ে। যাদের বেশিরভাগ ছিলেন ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা মানুষ। কারণ তারা এখানকার পথঘাট চিনতেন না।

কেরানীগঞ্জে গেলে এখনো সেখানে মনু ব্যাপারীর ঢাল, নজরগঞ্জ, কসাইভিটা ও নেকরোজবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেকগুলো গণকবর চোখে পড়েবে। স্থানীয়রা জানান, এর মধ্যে কেবল মনু ব্যাপারীর ঢালেই ওইদিন একসঙ্গে প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে একটি স্মৃতিসৌধ।

২ এপ্রিল এই হত্যাযজ্ঞের পরদিন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার-সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজ-এ প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল 'অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট মিসক্রিয়ান্টস অ্যাট জিঞ্জিরা।'

এই অংশটি উল্লেখ করে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে লিখেছেন, 'মর্নিং নিউজ-এর একটা হেডলাইনের দিকে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম: অ্যাকশান এগেইনস্ট মিসক্রিয়ান্টস অ্যাট জিঞ্জিরা…।

'গতকাল থেকে লোকের মুখে মুখে যে আশঙ্কার কথা ছড়াচ্ছিল, সেটা তাহলে সত্যি? ক'দিন থেকে ঢাকার লোক পালিয়ে জিঞ্জিরায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল। গতকাল সকালে পাকিস্তান আর্মি সেখানে কামান নিয়ে গিয়ে গোলাবর্ষণ করেছে। বহু লোক মারা গেছে।'

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র-এর অষ্টম খণ্ডে মফিজুল্লাহ কবীরের একটি রচনায় লেখা হয়েছে, 'মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরপাড়ে দস্যুরা ৬০ জনকে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। খোলা মাঠ ও গ্রাম দিয়ে যখন গ্রামবাসী ছোটাছুটি করছিল, তখন খানসেনারা উপহাসভরে ব্রাশফায়ার করেছে।'

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর একাত্তরের দশ মাস গ্রন্থে জিঞ্জিরার গণহত্যা নিয়ে বলা হয়েছে, 'পাক সেনাবাহিনীর জিঞ্জিরা অপারেশনের কোনো তুলনা নেই সমকালীন বিশ্বে। মিলিটারিরা সেদিন জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজারটি জ্বালিয়ে দেয়। চুনকুটিয়া-শুভাঢ্যা ধরে বড়িশুর পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাত মাইল এলাকা মিলিটারি ঘিরে ফেলে এবং নারী-শিশুনির্বিশেষে যাকে হাতের কাছে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। নারীদের চরমভাবে লাঞ্ছিত করেছে।'

সাবেক কূটনীতিবিদ আবদুল হান্নান ডেইলি স্টার পত্রিকায় জিঞ্জিরা গণহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, অলৌকিকভাবে তার পরিবার সেদিন বেঁচে গেলেও সেই নারকীয় ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর থেকেই তার স্ত্রী চিরদিনের জন্য স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন।

কেরানীগঞ্জে এই গণহত্যার দিনে শুভাঢ্যা ইউনিয়নের একটি গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। এই গণহত্যা নিয়ে তিনি তাঁর জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১ গ্রন্থে লিখেছেন, 'একটি ডোবার ভিতরে মাথা গুঁজে বসে তখন আমি এমন একটি করুণ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করি, যা আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না, পারিনি। আমি দেখি শেলের আঘাতে একজন ধাবমান মানুষের দেহ থেকে তার মস্তকটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছে আমি যে ডোবায় লুকিয়ে ছিলাম সেই ডোবার জলে, কিন্তু ওই মানুষটি তারপরও দৌড়াচ্ছে।'

এ বিষয়ে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান ও খায়রুল ইসলাম এক নিবন্ধে লিখেছেন, 'জগৎ-জোড়া মানুষ ভিয়েতনামের ঐতিহাসিক মাই লাই গণহত্যার কথা জানে, কিন্তু তার চেয়েও ভয়ংকর জিঞ্জিরা হত্যাকাণ্ডের খবর তেমন কেউ জানে না। আমরা উইকিপিডিয়া, উইকিজিরো ইত্যাদি ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখেছি, জিঞ্জিরা হত্যাকাণ্ড নিয়ে রয়েছে বিস্তর ভুল তথ্য। আমরা গভীর সন্দেহে ভেবেছি, কারা এই তথ্য সরবরাহ করছে, আমরা জানি কি?'

Comments

The Daily Star  | English
Yunus condemns lawyer’s murder in Chattogram

Keep calm, refrain from violence

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday condemned the murder of a lawyer in the port city of Chattogram.

6h ago