কামান্না ট্র্যাজেডি: সেই ঘুম আর কখনোই ভাঙবে না

এই বাড়িতে ঘুমিয়েছিলেন ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সেই ঘুম আর ভাঙেনি। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর। দিনভর বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালিয়ে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সেই ঘুম আর ভাঙেনি। ভোরের দিকে দখলদার বাহিনী চুপিসারে অভিযান চালিয়ে ঘুমন্ত অবস্থাতেই হত্যা করে তাদের।

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামে হানাদার বাহিনীর সেই নৃশংস হামলায় ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে স্থানীয় ২ জন নিহত হন।

গ্রামের প্রবীণরা জানান, ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশে ফিরে ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা গ্রামের ২টি টিনের ঘরে ক্যাম্প তৈরি করেন। এই ক্যাম্প থেকেই অপারেশন চালাতেন তারা। হামলার রাতে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অন্য জায়গায় ছিলেন। 

ঘটনার দিন ভোর ৪টার দিকে ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়। গ্রামবাসী গুলির শব্দ শুনে ভয়ে গ্রামের পশ্চিম পাশে আশ্রয় নেন। পরদিন সকালে তারা ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা, ১ নারীসহ ও ২ গ্রামবাসীসহ মোট ২৯ জনের মরদেহ দেখতে পান। ৫টি গণকবর খুঁড়ে মরদেহগুলো কলা পাতা দিয়ে মুড়িয়ে কবর দেন গ্রামবাসী।

শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: সংগৃহীত

টিনের ঘরগুলোর পাশেই এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। সেখানে একটি ফলকে ২৭ জন শহীদের তালিকা আছে।

এই ২৭ জন হলেন-মমিন হোসেন, আব্দুল কাদের, শহিদুল ইসলাম, সোলায়মান হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক (১), ওয়াহেদ আলী, রিয়াত মণ্ডল, আলমগীর হোসেন, মতলেব আলী, আলী হোসেন, শরিফুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, মো. আমিমুজ্জামান, তাজুল ইসলাম, মো. মনিরুজ্জামান, মো. মাসিম মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক (২), কাওছার আলী, সালেক হোসেন, আব্দুল আজিজ, আকবর আলী, সেলিম হোসেন, হোসেন আলী, রাশেদ আলী, গোলজার হোসেন, অধীর কুমার ও গৌর কুমার।

তাদের সঙ্গে প্রাণ হারানো ২ গ্রামবাসী হলেন— ফণী ভূষণ কুণ্ডু ও রাঙ্গা বিবি। তারা ২ জনই বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন।

ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. বিএম রেজাউল করিমের বয়স তখন ১০ বছর।

তিনি জানান, মাগুরার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পুরনো ২টি বাড়িতে অবস্থান করছেন বলে জানতেন গ্রামবাসী। এই বাড়িগুলোর মালিক মূলত মাধব চন্দ্র ভূঁইয়া। যুদ্ধ শুরুর পর ভারতে পালিয়ে যান তিনি।

২৫ নভেম্বর রাতে কয়েকজন যুবক গ্রাম থেকে চাল ও সবজি সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করেন। তবে কোনো একটি বিষয় নিয়ে বাদানুবাদ হওয়ায় ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ১৫ জন ক্যাম্প থেকে চলে যান। বাকি ২৭ জন না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন।

'দু:খের বিষয় হলো, তারা আর কখনোই জেগে ওঠেননি', রেজাউল করিম বলেন।

তার দেওয়া তথ্যমতে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে দেখে ফেলায় ফণী ভূষণ কুণ্ডু ও রাঙ্গা বিবিকে হত্যা করা হয়। 

পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে রেজাউল করিম বলেন, 'রাঙ্গা বিবি চাল ধুতে কুমার নদীতে গিয়েছিলেন।'

ওই সময় শৈলকুপা উপজেলা থানা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে ছিল। শহরের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. খাদেমুল ইসলামের মালিকানাধীন আরেকটি বড় বাড়িও পাকিস্তানিদের দখলে ছিল।

স্থানীয় সূত্রে তথ্য পেয়ে, শৈলকুপা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সেনারা একটি দল গঠন করে কামান্না গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়।

ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন মনোয়ার হোসেন। তিনি জানান,  স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এই ঘটনায় শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে প্রতি বছর দিনটি পালন করেন। 

এই বছর তারা গণকবরের পাশে 'কামান্না ট্র্যাজেডি' নামের একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। নাটকটি লিখেছেন প্রশান্ত হালদার এবং পরিচালনা করেছেন তানভীর নাহিদ খান।

প্রশান্ত হালদার বলেন, 'বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নাটকটি লেখা হয়েছে। আমরা গণকবরের পাশে নাটকটি মঞ্চস্থ করেছি, যাতে স্থানীয়রা তাদের গ্রামের এই গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারেন।'

অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

Train staffers call off strike

The strike was withdrawn after the union received assurances that their demands would be addressed

2h ago