ন্যাটো-ইইউ ও পুতিনের ১১ বিলিয়ন ডলারের গ্যাস পাইপলাইন
ইউরোপের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস রপ্তানির উদ্দেশ্যে বসানো একটি ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনকে অপ্রত্যাশিত ভূমিকায় নিয়ে গেছে। সবাই এখন নর্ড স্ট্রিম-২ নামের এই পাইপলাইনকে চলমান ভূরাজনৈতিক সংকটের একটি সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক বা অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করছে।
২০১৫ সালে প্রথম যখন এই পাইপলাইন বসানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে, তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কিছু সদস্য রাষ্ট্র এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল। তারা সতর্ক করে বলেছিল, এই প্রকল্প ইউরোপের মধ্যে রাশিয়ার প্রভাব বাড়াবে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার (৭৫০ মাইল) দৈর্ঘ্যের এই পাইপলাইনের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এটি এখন চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই ও অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। তবে এখন পর্যন্ত কার্যক্রম শুরু না হলেও এই পাইপলাইন সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমল থেকে 'মিত্র' হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। বিশেষত, এই বিভেদ এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান মার্শাল তহবিলের জ্যেষ্ঠ ফেলো ক্রিস্টিন বের্জিনার মতে, পাইপলাইন সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে মস্কো। 'নিরপেক্ষ গবেষক' ক্রিস্টিন মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএনকে বলেন, 'নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন সংক্রান্ত সব ঘটনাই রাশিয়ার জন্য বিজয়ের সমতুল্য।
'আমরা যদি ধরে নেই সবার মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করাই হচ্ছে রাশিয়ার মূল লক্ষ্য, আর যদি তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (ন্যাটো) মধ্যে একাত্মতা ভেঙ্গে দিতে চায়, সে ক্ষেত্রে বলা যায়, এই পাইপলাইনটি একটি চমৎকার নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।'
বেশ কয়েক বছর ধরে রাশিয়া ও জার্মানি যুক্তি দিয়ে আসছে যে, পাইপলাইনটি শুধু ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। আর এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগসূত্র নেই।
তবে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া থেকে আসা গ্যাসের সরবরাহ জ্বালানি উৎপাদন ও ঘরবাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রকারান্তরে জ্বালানি নিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় তেমন একটা নেই বললেই চলে। ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য রেকর্ড পরিমাণ উচ্চতায় চলে গেছে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে আশঙ্কা করছেন, স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে আরও ঝামেলা তৈরি হলে ইউরোপের গ্রাহকদের দুর্ভোগ বাড়বে।
রাশিয়া জ্বালানি সরবরাহের মাধ্যমে ইউরোপের বাকি দেশগুলোর ওপর চাপ তৈরির অভিযোগ অস্বীকার করলেও, আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) ইউরোপে গ্যাসের উচ্চ মূল্যের জন্য মস্কোকে দায়ী করে বলেছে, তারা ইচ্ছে করে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তারা ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির বিষয়টিকে অস্ত্রের মতো করে ব্যবহার করতে পারে বলে ধারণা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। তারা সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চালাচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালালে গ্যাসের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। সে পরিস্থিতিতে এই দেশগুলো তাদের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) উৎপাদন বাড়িয়ে সঙ্কটের সময়ে সহায়তা দিতে পারবে কিনা, তা যাচাই করাই এ আলোচনার মূল উদ্দেশ্য। মার্কিন প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা সিএনএনকে এ বিষয়টি জানিয়েছেন।
ইউক্রেনসহ পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই এই বলে সতর্ক করে আসছে যে, নতুন এই পাইপলাইন চালু হলে পুরো অঞ্চল রাশিয়ার প্রভাবের কাছে নতজানু হয়ে পড়বে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসে পড়ার পর থেকেই জ্বালানির মূল্য নিয়ে মতভেদের কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। ইতোমধ্যে রাশিয়া বেশ কয়েকবার ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে রাশিয়ার ইউক্রেনকে প্রয়োজন। কারণ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর কাছে তারা যে গ্যাস বিক্রি করে, তার বেশিরভাগই ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে যায়।
তবে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন চালু হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে। তখন রাশিয়া চাইলেই ইউক্রেনকে অবজ্ঞা করে অন্যান্য দেশে গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে।
এই পাইপলাইনটি রাশিয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশটির সরকারি রাজস্বের ৪০ শতাংশই আসে তেল ও গ্যাসের রপ্তানি থেকে। নর্ড স্ট্রিম-২ চালু হলে রাশিয়া প্রতি বছর সরাসরি ৫৫ বিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করতে পারবে। এই পাইপলাইনের মালিক দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম জানিয়েছে, ২০২১ সালে প্রতি ১ হাজার ঘন ফুট গ্যাস রপ্তানির জন্য গড় রপ্তানি মূল্য ২৮০ ডলার ধরা হয়েছিল। এই হিসাবে বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার আয় হতে পারে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে গ্যাজপ্রম এই প্রকল্পে ১১ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ করেছে।
ক্রিস্টিন বের্জিনা জানান, রাশিয়াকে ইউক্রেন আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখার জন্য পশ্চিমের সব ধরনের উপকরণ প্রস্তুত রাখা দরকার। ক্রিস্টিন আরও জানান, যদি এখন এই পাইপলাইনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এটাকে তারা অন্যায্য সুবিধা আদায়ের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে।
তার ভাষ্য, রাশিয়া এখন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। তারা পশ্চিমের শক্তিগুলোকে সরাসরি বলছে সেসব জায়গা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে, যেখানে তারা সেই ৯০ এর দশক থেকে মোতায়েন আছে। তারা এমনকি ন্যাটোর সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার ওপরেও তালা ঝুলিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ চাহিদাগুলো ইউরোপ বিষয়ে পশ্চিমের দর্শনের সঙ্গে মেলে না।
'সুতরাং, পশ্চিম চাইলেও রাশিয়ার ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে না'- যোগ করেন ক্রিস্টিন।
রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের মহাপরিচালক আন্দ্রে কর্তুনভ জানান, মস্কো নর্ড স্ট্রিম প্রকল্পকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৌশলগত সার্বভৌমত্ব লাভের অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করছে।
তিনি বলেন, 'যদি নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, যেটি খুবই সম্ভব, তাহলে এটি সে ধারণাকেই নিশ্চয়তা দেবে যে, অংশীদার হিসেবে ইউরোপের ওপর ভরসা রাখা যায় না। এবং আপনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন না। তারা কোনো কিছুতে একমত হতে পারে না এবং একতাবদ্ধ হয়ে কোনো সিদ্ধান্তও নিতে পারে না। সুতরাং, আপনি যদি কোন কিছু অর্জন করতে চান, তাহলে আপনাকে ওয়াশিংটনের কাছে যেতে হবে।'
রাশিয়া বারবার পশ্চিমকে সতর্ক করেছে নর্ড স্ট্রিম-২ কে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে টেনে নিয়ে না আসার জন্য। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ জানান, নর্ড স্ট্রিম-২ এর বিষয়টিকে রাজনীতিকরণের যেকোনো প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হবে।
পাইপলাইনটি নিঃসন্দেহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই একটি বিষয়কে পুঁজি করে তাকে ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে ফেরানো যাবে কিনা, কিংবা এই পাইপলাইনের ওপর সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার কাছে ততটুকু গুরুত্বপূর্ণ কিনা, সে বিষয়ে বিশ্লেষকরা সন্দেহ পোষণ করেছেন।
কর্তুনভ জানান, যদি এই প্রকল্প ব্যর্থ হয়, এটি গ্যাজপ্রম ও রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য বড় আকারের ক্ষতির কারণ হবে। তবে এর মানে এই না যে, এতে দমে গিয়ে বা ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে রাশিয়ানরা বলবে যে, 'ঠিক আছে, আপনারা ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন।'
ক্রিস্টিন বলেন, 'এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, তার (পুতিনের) চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? তার হাতে অর্থ আছে, মুদ্রার সঞ্চয় আছে। দেশটি চাইলে কিছু টাকা জলেও ফেলে দিতে পারে। তবে তিনি কী অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও পাইপলাইন- দুটোই হারাতে চান? এমন চরম মূল্য দিতে কী তিনি প্রস্তুত?'
Comments