রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত ৫ রুশ জেনারেলের মৃত্যুর নেপথ্যে
আজ ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ২৬ তম দিন। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষের অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের হতাহতের খবর এসেছে। তবে মৃতের সংখ্যা নিয়ে রয়েছে মতভেদ।
বিভিন্ন পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ৪ থেকে ৭ হাজারের মতো রুশ সেনা নিহত হয়েছেন এ যুদ্ধে। ইউক্রেন দাবি করেছে, সংঘর্ষে ১৪ হাজারের মতো রুশ সেনা ও ৫ জেনারেল নিহত হয়েছেন।
তবে সম্প্রতি ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২ মার্চ পর্যন্ত মোট ৪৯৮ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। এছাড়াও, কেবল একজন জেনারেলের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে ক্রেমলিন।
যেকোনো দেশের সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ সদস্যরা সাধারণত নেপথ্যে থাকেন; সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার চেয়ে যুদ্ধ কৌশল নির্ধারণ ও পরিকল্পনার দিকে তারা বেশি জোর দেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এই শীর্ষ জেনারেল কারা এবং কেনই বা তারা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ অংশ নিতে গেলেন।
মেজর জেনারেল আন্দ্রেই সুখোভেতস্কি (২৫ জুন ১৯৭৪ – ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২)
আন্দ্রেই সুখোভেতস্কি একজন উচ্চপদস্থ রুশ জেনারেল। চলমান সংঘর্ষে তিনিই প্রথম শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, যার মৃত্যুসংবাদ রাশিয়ার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে।
সুখোভেতস্কি রাশিয়ার ৭ম এয়ারবোর্ন ডিভিশনের কমান্ডিং জেনারেল ও ৪১তম সম্মিলিত অস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। সামরিক বাহিনীর এক সূত্র অনুযায়ী, তিনি স্নাইপারের গুলিতে নিহত হন।
দক্ষিণ-পূর্ব রাশিয়ার ক্রাসনোডার অঞ্চলের স্থানীয় সামরিক কর্মকর্তাদের একটি সংস্থা সুখোভেতস্কির মৃত্যু নিশ্চিত করে। তিনি সিরিয়ায় রুশ সামরিক বাহিনীর অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওয়েবসাইট বেলিংক্যাটের নির্বাহী পরিচালক ক্রিস্টো গ্রোজেভ এক টুইটার বার্তায় জানান, জেনারেল সুখোভস্কির মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত হলে তা রুশ বাহিনীর মনোবল অনেকাংশে কমিয়ে দেবে।
সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ও স্টেশন চিফ ড্যান হফম্যানের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক পোস্ট জানায়, 'যদি ঘটনা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এটি অনেক বড় ব্যাপার।'
মেজর জেনারেল ভিতালি গেরাসিমভ (৯ জুলাই ১৯৭৭ – ৭ মার্চ ২০২২)
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, রাশিয়ার ৪১তম সম্মিলিত অস্ত্র বাহিনীর প্রথম ডেপুটি কমান্ডার ভিতালি গেরাসিমভ গত ৭ মার্চ পূর্ব দিকের শহর খারকিভের কাছাকাছি জায়গায় নিহত হন।
বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী একটি রেকর্ডিং প্রকাশ করেছে, যেখানে রুশ নিরাপত্তা বাহিনীর দুই সদস্য গেরাসিমভের মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করেন। তারা একই সঙ্গে অভিযোগ করেন, তাদের সুরক্ষিত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ইউক্রেনে ঠিক মত কাজ করছে না।
তবে এখনো ভিতালির মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করেনি ক্রেমলিন।
ভিতালি (৪৫) সিরিয়া ও চেচনিয়ার সামরিক অভিযানে অংশ নেন এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল অভিযানেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভিতালি সিরিয়া ও ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বীরত্বের জন্য সম্মানসূচক পদক পান।
২০১৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি মেজর জেনারেল হন।
মেজর জেনারেল আন্দ্রেই কোলেসনিকভ (৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ – ১১ মার্চ ২০২২)
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর দাবি অনুযায়ী, রুশ বাহিনীর ৩য় জেনারেল হিসেবে কোলেসনিকভ প্রাণ হারান।
গত বছরের ডিসেম্বরে পদোন্নতি পাওয়া কোলেসনিকভ রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের সামরিক ডিস্ট্রিক্টের ২৯তম সম্মিলিত অস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।
এর আগে তিনি কসোভো ও চেচেন যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ৪র্থ গার্ডস ট্যাংক ডিভিশনের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও চিফ অফ স্টাফ ছিলেন।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে এ বিষয়ের সঙ্গে জড়িত পশ্চিমের একটি দেশের একজন কর্মকর্তা দ্য প্রেস অ্যাসোসিয়েশন কে জানান, রুশ সেনাবাহিনীতে মনোবলের অভাব দেখা দিয়েছে। এ কারণে কোলেসনিকভের মত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা সম্মুখ যোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন।
মেজর জেনারেল ওলেভ মিতায়েভ (১৯৭৪ – ১৫ মার্চ ২০২২)
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, মেজর জেনারেল ওলেগ মিতায়েভ মারিউপোল শহরের কাছাকাছি নিহত হন। দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই বন্দর নগরী ইউক্রেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই চেইন শহরে, যার দখল নেওয়ার জন্য প্রায় ২ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তীব্র হামলা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী।
ইউক্রেনের বহুল আলোচিত ন্যাশনাল গার্ডের আজভ রেজিমেন্ট জেনারেল মিতায়েভকে হত্যার দাবি জানায়।
তিনি ছিলেন রুশ সেনাবাহিনীর ১৫০তম মোটোরাইজড রাইফেল ডিভিশনের কমান্ডার। অপেক্ষাকৃত নতুন এই বাহিনী ২০১৬ সালে গঠিত হয়, যেটি ছিল ইউক্রেন সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত রোস্টোভ অঞ্চল ভিত্তিক একটি বাহিনী।
ইউক্রেন দাবি করেছে, এই বাহিনী গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে মদদ দেওয়া। তবে রাশিয়া এ ধরনের কোনো দাবি মেনে নেয়নি।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক বক্তৃতায় 'চতুর্থ জেনারেলের মৃত্যু হয়েছে' দাবি করার পর ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অ্যান্টন গেরাশচেংকো জেনারেল মিতায়েভের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করেন।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল আন্দ্রেই মর্দভিচেভ (১৪ জানুয়ারি ১৯৭৬ – ১৬ মার্চ ২০২২)
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, খেরসন বিমানবন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত চেরনোবায়েভকা শহরের বিমান ঘাঁটিতে ইউক্রেনের বাহিনী কামান হামলা চালায়। সে হামলায় রুশ বাহিনীর এক সামরিক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিহত হয়েছেন বলে দাবি করে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী।
বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত শনিবার এক ফেসবুক পোস্টে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ এই দাবি করেছেন। তবে বিবিসি বিষয়টি যাচাই করতে পারেনি।
ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, রুশ বাহিনীর দক্ষিণ সামরিক জেলার অষ্টম সম্মিলিত অস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আন্দ্রেই মর্দভিচেভ মারা গেছেন।
রাশিয়ার কতজন জেনারেল ইউক্রেনে আছেন
বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ২০ জন জেনারেল ইউক্রেনে গেছেন। যদি জেনারেলদের মৃত্যু সংবাদ সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, ইতোমধ্যে তাদের ২০ শতাংশ শক্তিমত্তা (নেতৃত্বের দিক দিয়ে) কমে গেছে।
এ ধরনের বড় আকারের ক্ষয়ক্ষতি থেকে কিছু বিশেষজ্ঞ মত প্রকাশ করেন, জেনারেলরা শুধুমাত্র 'ভুল সময়ে ভুল জায়গায়' ছিলেন না, তাদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করে হত্যা করা হয়েছে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্লেষক, গবেষণা ফেলো ও সহযোগী পরিচালক ড. মার্গারিটা কোনায়েভ বলেন, 'আমার মনে হয় না এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একজনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারতো, কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেককেই লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে।'
জেনারেলরা যখন লক্ষ্যবস্তু
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি বিবিসিকে জানান, ইউক্রেনের একটি সামরিক গোয়েন্দা দল আছে, যারা রাশিয়ার উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করছে।
তিনি জানান, 'তারা গুরুত্বপূর্ণ জেনারেল, বৈমানিক ও আর্টিলারি কমান্ডারদের খুঁজে বের করছেন।' ডঃ রিতা আরও জানান, ইউক্রেন সামরিক সক্ষমতার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে থাকলেও, এ ভাবে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তাদেরকে হত্যা করা এক নতুন ধরনের তথ্য প্রযুক্তির যুদ্ধের অবতারণা করতে পারে।
'এতে (জেনারেলদের মৃত্যুতে) ইউক্রেনের মনোবল নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। এটি এক ধরনের বিজয়। এটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে', যোগ করেন তিনি।
ইউক্রেন যদি কোনো নিদিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে চায়, তাহলে নিশ্চিতভাবে তার অবস্থান জানতে হবে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, রাশিয়া পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিরাপদ চ্যানেলের বদলে অরক্ষিত চ্যানেল ব্যবহার করছেন। ফলে খুব সহজেই লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান জানতে পারছে ইউক্রেনীয়রা।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজাইকা বিবিসিকে জানান, 'যদি রাশিয়ানরা মোবাইল ফোন বা এনালগ রেডিও ব্যবহার করে, তাহলে ব্যাপারটা ইউক্রেনীয়দের জন্য প্লেটে খাবার সাজিয়ে দেওয়ার মত হবে।'
ভিতালি গেরাসিমভের মৃত্যুর পর রেডিও যোগাযোগের রেকর্ডিং প্রকাশ এ কথার প্রমাণ দেয়।
জেনারেলরা কেন সম্মুখ যুদ্ধে?
বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেকোনো আধুনিক যুদ্ধে উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের এত কাছে থেকে নিজেদের ঝুঁকিতে রাখার নজির নেই। বিশেষ করে, তাদেরকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর বিষয়টি সত্য হলে তো কথাই নেই।
তবে পশ্চিমের সূত্ররা বিশ্বাস করেন, জেনারেলরা প্রায় স্তিমিত হয়ে পড়া কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এ উদ্যোগ নিচ্ছেন।
এবং একই সঙ্গে, প্রথাগতভাবে রুশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তবে এই প্রথার পরিবর্তন হচ্ছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতি
গত তিন বছর ধরে রুশ বাহিনী নতুন এক উদ্যোগ নিয়েছে।
সম্মুখ যোদ্ধাদের হাতে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা জেনারেলদের মুখাপেক্ষী না থাকেন। তবে এরপরেও বহুবছরের চর্চা এখনো পুরোপুরি যায়নি। জেনারেলদের পাশে না পেলে সাধারণ সেনারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।
অনেকে ভাবছেন ইউক্রেনের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে দিশেহারা হয়ে গেছে রুশ বাহিনী। ফলে জেনারেলরাও অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমে গেছেন।
তবে মারিউপোলে রুশদের সুসংহত হামলা ও ২ সপ্তাহের ব্যবধানে গুরুত্বপূর্ণ শহর পতনের দ্বারপ্রান্তে চলে আসার বিষয়টি সশৃঙ্খল সামরিক অভিযানের কথা জানায়। এর আগেও 'রুশ ট্যাংকের জ্বালানী শেষ হয়ে গেছে', 'রসদের অভাবে ভুগছে রুশরা' বা 'হতবুদ্ধি হয়ে গেছে রুশ সেনা', এরকম সংবাদ এসেছে পশ্চিমের গণমাধ্যমে।
রুশ জেনারেলদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর সংবাদও একইভাবে অতিরঞ্জিত হতে পারে।
Comments