মারিউপোল শহর এখন আতঙ্কের নাম
রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর সর্বশেষ লক্ষ্যবস্তু ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের শহর মারিউপোলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে ধারাবাহিক আক্রমণ। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, প্রায় ৪ লাখ মানুষ ২ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে শহরটিতে আটকে আছেন। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে শহরটি।
ইতোমধ্যে মারিউপোলের বিভিন্ন বেসামরিক স্থাপনার ওপর রুশ হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে রুশ বাহিনী এ দাবি পুরোপুরি অস্বীকার করেছে।
আর্ট স্কুলে বোমাবর্ষণ
আজ রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে দেওয়া মারিউপোলের সিটি কাউন্সিলের এক বক্তব্যে জানা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত শহরের একটি আর্ট স্কুলের উপর বোমাবর্ষণ করেছে রুশ বাহিনী।
সংবাদ সংস্থা সিএনএনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৪০০ মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কাউন্সিল অভিযোগ করেছে, আক্রমণে দালানটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
হতাহতের সংখ্যা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে অসংখ্য মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছেন বলে জানিয়েছে কাউন্সিল।
বাসিন্দাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ
গত শনিবার মারিউপোলের সিটি কাউন্সিল অভিযোগ করে, শহরের বাসিন্দাদের জোর করে রাশিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে রুশ বাহিনী। অভিযোগ অনুযায়ী, রাশিয়ার বাহিনী মারিউপোলের বাসিন্দাদের আটক করে রুশ ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। সেখানে তাদের ফোন ও নথি পরীক্ষা করে তাদেরকে রাশিয়ার দুর্গম শহরগুলোতে পাঠানো হচ্ছে।
মারিউপোলের মেয়র ভ্যাদিম বইচেংকো রাশিয়ার এ ধরনের উদ্যোগকে ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর জোর করে মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
ধারাবাহিক বোমাবর্ষণ
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা গেছে, যখনই মারিউপোলের বাসিন্দারা ভূগর্ভস্থ বাংকার থেকে বের হচ্ছেন, তখনই তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
ইউক্রেনের জাতীয় রক্ষী বাহিনীর আজভ রেজিমেন্টের মেজর ডেনিস প্রকোপেংকো দাবি করেছেন, কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দর এলাকার দখল নেওয়ার জন্য তুমুল যুদ্ধ চলছে ২ বাহিনীর মধ্যে।
'শহরটিতে এখন স্থল ও আকাশপথে বিরামহীন হামলা চলছে', যোগ করেন তিনি।
রাস্তায় মরদেহ
প্রকোপেংকো আরও জানান, মানুষ মাটির নিচের আশ্রয় ছেড়ে বের হতে চাচ্ছে না। এমন কী, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহের জন্যও না। এর অর্থ, মানুষ কম পরিমাণ খাবার খাচ্ছে ও পানি পান করছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মত মৌলিক সেবাগুলোর সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মানুষের মরদেহ রাস্তায় ফেলে রাখা হচ্ছে। সেগুলো সংগ্রহ করার মত কেউ নেই, বা থাকলেও, মারাত্মক ঝুঁকির কারণে কেউ এগিয়ে আসছে না।
থিয়েটারে হামলা
এর আগে গত বুধবার শহরের একটি থিয়েটারে আক্রমণের অভিযোগ আসে। সে ঘটনার হতাহতের মোট সংখ্যা এখনো জানা যায়নি।
শনিবার প্রকাশিত একটি স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, থিয়েটার ভবনের দুই-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর্ট স্কুলের মতো এই থিয়েটারটিও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। স্পষ্টভাবে আকাশ থেকে দেখা যায়, সেভাবে রুশ ভাষায় 'শিশু' শব্দটি লেখা ছিল সেখানে। থিয়েটার যাতে উড়োজাহাজ হামলার হাত থেকে রক্ষা পায়, সে জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তারপরও আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ঐতিহাসিক থিয়েটারটি, অভিযোগ মারিউপোলের বাসিন্দাদের।
কর্তৃপক্ষের ধারণা, ৮০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটক আছেন।
ইস্পাত কারখানায় হামলা
ইউক্রেনের অন্যতম প্রধান একটি ইস্পাত কারখানায় হামলার বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। আজভ স্টিল প্ল্যান্ট নামে পরিচিত এই কারখানার বিষয়ে গত শুক্রবার একজন সরকারি উপদেষ্টা জানান, ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের পরাজিত করে রাশিয়া এ কারখানার দখল নিয়েছে।
তবে শনিবার আজভ ব্যাটেলিয়ন জানায়, কারখানা এখনও তাদের দখলে আছে। উল্লেখ্য, মারিউপোলে আজভ ব্যাটেলিয়নের প্রচুর সদস্য মোতায়েন আছে।
যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা প্রতিবেদন
আজ রোববার যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সংক্রান্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রাশিয়ার সেনাবাহিনী বিভিন্ন শহরে স্থলপথে আক্রমণে সহায়তার জন্য কামান ও ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার অব্যাহত রাখবে।
এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের শহরগুলোকে দখল করতে না পারায় রুশ বাহিনী নগর এলাকায় নির্বিচারে শেল বর্ষণ করছে।
আবাসিক এলাকায় শেলবর্ষণের ফলে 'বড় আকারের ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে এবং অনেক বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন', যোগ করে মন্ত্রণালয়।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি কী বলছেন
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি বলছেন, 'মারিউপোলে রাশিয়ার ধারাবাহিক ও নির্বিচার আক্রমণ জঙ্গি হামলার সমতুল্য এবং মানুষ এ ঘটনাকে শত বছর পরও মনে রাখবে।'
রোববার সকালে ফেসবুকে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ কথা বলেন।
'মারিউপোলের ঘটনা যুদ্ধাপরাধের নিদর্শন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে', যোগ করেন জেলেনস্কি।
পরিশেষে
পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, রুশ বাহিনীর আক্রমণ স্তিমিত। তারা রসদের অভাবে ভুগছে, কিয়েভ থেকে বেশ খানিকটা দূরে সাঁজোয়া গাড়ি ও ট্যাংকের বহর জ্বালানির অভাবে থেমে আছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন প্রতিবেদনে রুশ বাহিনীর সেনা নিহত হওয়া, অসংখ্য ট্যাংক, হেলিকপ্টার ও উড়োজাহাজ ধ্বংসের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু মারিউপোলের পরিস্থিতি ভিন্ন কথা বলছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পিত হামলার মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ 'সাপ্লাই চেইন' শহরকে দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে রাশিয়া।
Comments