মিরন জল্লা হরিজন সিটি কলোনি: ‘আর কিছু নয়, শুধু শহীদদের স্বীকৃতি চাই’
আজ ২২ নভেম্বর; ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজধানীর আগা সাদেক লেনের মিরন জল্লা হরিজন সিটি কলোনি থেকে চিরতরে হারিয়ে যান ১০ জন। কুখ্যাত রাজাকারদের ইন্ধনে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে প্রাণ হারান এই মানুষগুলো। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করাই ছিল তাদের 'অপরাধ'!
এ ঘটনার ৫০ বছর কেটে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো স্বীকৃতি পাননি তারা। বরং, পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে হারিয়ে মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন স্বজনরা।
কলোনির বাসিন্দারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেন এখানকার বাসিন্দারা। ঝাড়ুর মধ্যে করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র পার করতেন এখানকার বাসিন্দারা। এর বাইরে খাদ্য সহায়তাও দিতেন তারা।
ওই সালের ২১ নভেম্বর মধ্যরাতে এ কলোনি থেকে হরিজন সম্প্রদায়ের ১০ সমাজসেবককে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এরপর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকি, তাদের মরদেহও পাননি স্বজনরা।
২২ নভেম্বর শহীদ হওয়া হরিজন সম্প্রদায়ের ১০ জন হলেন—মহাবীর লাল সামুন্দ, নান্দু লাল, আনোয়ার লাল, ঈশ্বর লাল, খালবাল দাস, ঘাশিটা দাস, শংকর দাস হেলা, নান্দা লাল, লালু দাস ও রামচরণ।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী ওই ১০ জনের স্মৃতির উদ্দেশে হরিজন সেবক সমিতি এখানে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে। প্রতিবছর ২২ নভেম্বর সন্ধ্যায় শহীদদের স্বজন ও কলোনিবাসী পুষ্পমাল্য অর্পণসহ নানা কার্যক্রমের আয়োজন করে থাকেন।
গতকাল রোববার দুপুরে আগা সাদেক খান লেনের মিরন জল্লা হরিজন সিটি কলোনিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে '২২ নভেম্বর শহীদ দিবস' পালনের প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যেই স্মৃতিস্তম্ভটি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে।
কলোনিতে অবস্থিত মিরনজুল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান গেটে হরিজন সেবক সমিতির পক্ষ থেকে '২২ নভেম্বর শহীদ দিবস অমর হোক' শিরোনামে ব্যানার টাঙানো হয়েছে।
কলোনি প্রাঙ্গণে কথা হয় আনোয়ার লালের স্ত্রী বেনোদেবীর সঙ্গে। ৫০ বছর আগের সেই কালরাতের কথা মনে করে এখনও অশ্রুসিক্ত হন এই বৃদ্ধা।
সে রাতের স্মৃতি স্মরণ করে ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সে রাতে কথা মনে পড়লে এখনো শরীরে রোম দাঁড়িয়ে যায়। ২ মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। গভীর রাতে দরজায় ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। উনি (আনোয়ার লাল) দরজা খুলে দিতেই ভয়ে সিটিয়ে যাই। অস্ত্রের মুখে তাকে ঘর থেকে পাকিস্তানিরা তুলে নিয়ে যায়।'
মুক্তিযুদ্ধে তার স্বামীর ভূমিকার স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, 'ওই সময় দেখতাম তিনি পাউরুটি, কলা, চিড়া, গুড় নিয়ে ঘরে আসতেন। এবং সেগুলো লুকিয়ে রাখতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন—এসব তোমার ভাবার বিষয় না। পরে জেনেছি, তিনি খাবারগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে আনতেন।'
তিনি আরও বলেন, 'ভয়াবহ দিন কেটেছে ৩ বাচ্চাকে নিয়ে। উনার স্ত্রী হিসেবে বিমানে চাকরি পেয়েছিলাম। সেখান থেকেও অবসরে চলে গিয়েছি। ৫০ বছর পার হয়ে গেছে, আমরা কোনো স্বীকৃতি পাইনি। শুধুমাত্র ২০১৩ সালের ৭ জুলাই "ডেইলি স্টার আনসাং হিরোজ অব বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার ১৯৭১" সম্মাননা পেয়েছি। কিন্তু, সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি পাইনি।'
'আর কিছু নয়, শুধু শহীদদের স্বীকৃতি চাই,' যোগ করেন তিনি।
বেনোদেবীর মতো বাকি ৯ শহীদ পরিবারকেও এমন শোকাবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। হরিজন সম্প্রদায়ের হওয়ায় বাইরের সমাজেও নানা বাধার মুখে পড়েছেন তারা।
এ বিষয়ে হরিজন সেবক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্মল চন্দ্র দাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম দিকে তো আমরা কথাই বলতে পারিনি। পরবর্তীতে আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতির জন্য যোগাযোগ করেছি। এমনকি, আমাদের এই প্রাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে অতিথি করে এনেও, আমাদের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু, আমরা এখনো স্বীকৃতি পাইনি।'
'স্বীকৃতি পেলে পরিবারের সদস্যরা ভাতা পেতেন, চাকরি পেতেন। কিন্তু কোনকিছুই হয়নি,' যোগ করেন তিনি।
২২ নভেম্বরের কর্মসূচির বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের কলোনির চারপাশে রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে। এ কারণে এবার আমরা অতিথি না ডেকে সীমিত পরিসরে শহীদ দিবস পালন করছি। স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণের পাশাপাশি পুরোহিতের মাধ্যমে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে গীতা পাঠ করা হবে। এর পাশাপাশি কলোনির বাসিন্দাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।'
Comments