বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি প্রসঙ্গে যা বললেন শিক্ষামন্ত্রী
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি হয়েছে জানিয়ে এর সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির পরিবারের সদস্যরা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগেই জমির দাম বেশি দেখিয়ে 'প্রভাবশালী' গোষ্ঠী জমির দলিল করে নিয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কথা বলেছেন গণমাধ্যমের সঙ্গে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, 'যেটি নিয়ে কথা বলতে চাই সেটি কিছুটা ব্যক্তিগত। কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টা আমার নজরে এসেছিল। আমি তখন সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবার সুযোগ পাইনি। আপনারা জানেন যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এরপর একজন আমাকে একটা ক্লিপ পাঠান। তারপরে আমি খোঁজ নিই যে কী ব্যাপার। আজকে দেশের একটি প্রধান দৈনিক তাদের লিড নিউজ করেছে। এটি হলো চাঁদপুরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যে জমি অধিগ্রহণ, সে বিষয়ে একটা রিপোর্ট হয়েছে।'
'সেখানে বলা হয়েছে যে অধিগ্রহণের জন্য প্রথমে জমির যে দাম ধরা হয়েছিল, সেই দাম ছিল অনেক বেশি। পরে আবার প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। তখন সেটি কমে এসেছে। সেখানে সরাসরি হয়তো আমার কথা না বললেও, আমার পরিবারের সদস্য আমার নিজের ভাইকে জড়ানো হয়েছে। আমার অন্যান্য রাজনৈতিক সহকর্মী কয়েকজনকে জড়িয়ে বলা হয়েছে যে আমার পরিবার এই জমিতে লাভবান হবেন, সেজন্য জমির দাম অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।'
'প্রথম কথা, চাঁদপুরে আমার কোথাও ক্রয়সূত্রে কোনো ধরনের কোনো জমি নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে হয়তো পৈত্রিক ভিটায় আমার অধিকার থাকতে পারে। ১৩ বছর হতে চলল আমি সেখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। কিন্তু আমার নিজের কোনো জমি সেখানে নেই।
দ্বিতীয়ত, যে জমিটি নিয়ে কথা বলা হচ্ছে সেখানে আমার ভাইয়ের ব্যাপারে একটা কথা বলা হচ্ছে। আমি যতদূর জানি বা যা তথ্যপ্রমাণ আছে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তিনি চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগেরও সহ-সভাপতি। তিনি লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নেই একটি হাসপাতাল করতে এবং একটি বৃদ্ধাশ্রম করতে কিছু জায়গা কিনছিলেন। অল্প অল্প করে কিনছিলেন।
যখন চাঁদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়, যেহেতু আমি শিক্ষামন্ত্রী, সেই কারণে তিনি ওই জমিটি বিক্রি করে দেন।
তৃতীয়ত, জমি অধিগ্রহণের জন্য জমির দাম নির্ধারণ করেন জেলা প্রশাসক।'
'যা অভিযোগ এসেছে তাতে বুঝতে পারছি সেটা হলো, প্রথমে একটা প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী জমির দাম দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। এখানে ৬২ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে,' বলেন শিক্ষামন্ত্রী।
তিনি বলেন, 'ওই প্রাক্কলনের পর ৩ মাসেরও বেশি সময় আর কিছু করা হয়নি। পরে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। আগে যারা প্রাক্কলন করেছিলেন তাদের বোধহয় বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। ১৩ জনের কমিটি আরেকটি প্রাক্কলন নিয়ে আসে। সেখানে বলা হচ্ছে যে জমির দাম ১৯৩ কোটি টাকা বাজারমূল্য। দুটোই এসেছে প্রশাসনের মাধ্যমে। অভিযোগে দেখছি জমির দাম ২০ গুণ ধরা হয়েছে। তাহলে ১৯৩ কোটি টাকার ২০ গুণ কীভাবে ৫৫৩ কোটি টাকা হয়?'
দীপু মনি বলেন, 'আরেকটি অভিযোগ করা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একটা টেলিভিশনে একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন যে এটা ভাঙনপ্রবণ জায়গা। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় টিকবে না।
এ জায়গাটাকে আমরা কেন নির্ধারণ করলাম? এটার বেলায় কয়েকটি জায়গা দেখা হয়েছিল। কতগুলো বিবেচনায় আমরা এ জায়গাটা নির্বাচন করি। একটা হলো, চাঁদপুর শহর অনেক ছোট এবং অনেক ঘনবসতি। শহরের মধ্যে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাইরে দুটো জায়গা ছিল হাইওয়ের ওপরে। আমরা জানি যে যেমন জাহাঙ্গীরনগরে বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটু সমস্যা হলেই হাইওয়েগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সে কারণে আমরা হাইওয়েতে চাইনি। একটু পাশে চেয়েছিলাম। তাছাড়া চাঁদপুর বা শরীয়তপুর থেকে যেন আসতে পারে, মেডিকেল কলেজ করার সময়ও আমরা এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছিলাম।
সব বিবেচনায় লক্ষ্মীপুরের এই জমিটি আমরা পছন্দ করেছিলাম। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেও প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হয়েছে। এই জমিটির পাশে স্থায়ী বাধ আছে, বেড়িবাঁধ আছে, তারপর এই জমিটি। এখানেও ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে।
এই অধিগ্রহণ থেকে আমার বা আমার পরিবারের কোথাও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি মনে করি আমাকে বা আমার পরিবারের কাউকে জড়িয়ে এই ধরনের রিপোর্ট ভিত্তিহীন, অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।'
তিনি আরো বলেন, 'আমার জেলারই একজন সংসদ সদস্য একটা আর্টিকেল লিখেছেন। দেখুন আমরা একই দল করি। আপনাদের কাছে কিছু লুকোবার নেই আমার। আমার দিক থেকে আমি তাদের এই কাজ সম্পর্কে আমার যা কিছু বলার, দলের সাধারণ সম্পাদক তাদের কাছে আমি এই কাগজগুলো পাঠিয়েছি। সব রেকর্ডিং পাঠাতে পারিনি। আমি আমার দলীয় ফোরামের বাইরে তাদের সম্পর্কে আমি মন্তব্য করতে চাই না। আমার এলাকায় আমার দলের হোক বা যেই হোক, আমার এলাকায় কখনো কারো ব্যাপারে যদি কোনো অভিযোগ ওঠে, আমি তাদের সঙ্গে সেটা নিয়ে কথা বলি, যথাযথ ব্যবস্থা নিই। এমনকি ভিন্ন দলের লোকের অভিযোগ থাকলেও আমার কাছে আসে। তার কারণ, কোনো অভিযোগ কেউ করলে, আমি সেটা খতিয়ে দেখি। সমাধান করার চেষ্টা করি।'
'প্রশাসনিকভাবে নিশ্চয়ই আমি চাই এটার তদন্ত হোক। আমাদের মন্ত্রণালয়ের দিক থেকেও তদন্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সব জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হবে। অনেকগুলো পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেমন অতিরিক্ত বড় হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীর চাপ বেড়েছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সমস্যা সৃষ্টি হয়, এই সমস্যাগুলো হয়তো তখন থাকবে না। যদি অনেক বেশি বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে এত বেশি অবকাঠামো করা লাগে না,' যোগ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, 'যদি এর পেছনে অনেক বড় ষড়যন্ত্র থাকে বা যেটাই হোক, সেটা তো উদঘাটন হওয়া প্রয়োজন। যারা এই কাজগুলো করেন তারা ভুলে যান যে সহকর্মী, আত্মীয় পরিজনসহ অনেক মানুষকে যে বিড়ম্বনায় ফেলা হয়, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, তাদের পরিবারের মানুষদের তো দায়দায়িত্ব থাকে না। কিন্তু তাদেরকেও সমাজে অনেক বেশি ভুগতে হয়।'
'রাজনীতিতে সততা নিয়ে প্রচুর মানুষ চলে। কিন্তু এটাও ঠিক অন্য সব পেশার মতো রাজনীতিতে অনেক মানুষ আছে যারা সততা নিয়ে চলেন না। কিন্তু যারা সততা নিয়ে চলেন তাদের যদি আক্রান্ত হতে হয়, তাহলে রাজনীতিতে আমরা সৎ মানুষ চাইব আবার সৎ মানুষকে আক্রান্ত করব, দুটো কি একসঙ্গে যায়?'
Comments