পাগলা শিয়ালের আক্রমণে আতঙ্কিত গাইবান্ধার ৫ গ্রামের মানুষ

১ মাসে শিয়ালের আক্রমণে নিহত ১ আহত ১০, প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ গ্রামবাসীদের
গাইবান্ধার পাগলা শিয়ালের কোনো ছবি এখনো তোলা যায়নি। ছবি: সংগৃহীত

গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ীতে গত ১ মাসে প্রায় ১০-১১ জনকে হামলা করেছে র‍্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত শিয়াল। আক্রান্তদের মধ্যে কয়েকজন নারী এবং শিশুও আছে। পলাশবাড়ী উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের হরিণাথপুর, তালুক কেঁওড়াবাড়ি, কিশামত কেঁওড়াবাড়ি, খামার বালুয়া ও ফতের ভিটা এ ৫টি গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।

আক্রান্তদের মধ্যে স্থানীয় মসজিদের ইমাম মো. ফেরদাউস সরকার রুকু (৫২) গত ১৮ অক্টোবর সকালে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান এবং বাকিরা জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাকসিন নিয়েছেন।

আজ শনিবার বিকেলে হরিনাথপুর ও তালুক কেঁওড়াবাড়ি গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মানুষ এখনো আতঙ্কে দিন পার করছেন। কেউ কোথাও গেলে লাঠি রাখছেন সঙ্গে। ভয়ে অনেকে বাড়ি থেকেই কম বের হচ্ছেন। কৃষকরা মাঠে গেলেও সঙ্গে রাখছেন লাঠি।

স্থানীয় কৃষক শফিকুল ইসলাম ভয়ে লাঠি হাতে বসে আছেন ধান খেতের পাশে। ছবি: মোস্তফা সবুজ

স্থানীয়রা বলছেন, বিকেলের আগেই সব কাজ শেষ করে তারা ঘরে ফিরছেন এবং রাতে বের হচ্ছেন না।

তাদের অভিযোগ, সেপ্টেম্বর মাসের ২৯ তারিখ থেকে প্রাণীটির আক্রমণ শুরু হলেও, এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য স্থানীয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

গত ১ মাসে পাগলা শিয়াল হরিনাথপুর গ্রামের ৪ জন, তালুক কেঁওড়াবাড়ি গ্রামের ২ জন, কিশামত কেওড়াবাড়ি গ্রামের ১ জন, খামার বালুয়া গ্রামের ১ জন এবং ফতের ভিটা গ্রামের ১ জনকে কামড় দিয়েছে।

শিয়ালের আক্রমণে নিহত ইমাম ফেরদাউসের মা ফজিলেতুন নেছা (৬৫) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২৯ সেপ্টেম্বর সকালে আমার ছেলে বাড়ির পাশে ধান খেতে ঘাস কাঁটতে যায়। তখন একটা শিয়াল তাকে আক্রমণ করে নাক ও ঠোঁটের মাংস ছিঁড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে তাকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি আনা হয়। ১৮ দিন পরে আবার তার প্রচণ্ড জ্বর আসে ও মাথা ব্যথা শুরু হয়। তখন আবার তাকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা তাকে রংপুর মেডিকেলে পাঠায়। ১৭ অক্টোবর তাকে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। ১৮ তারিখ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'পানি দিলেই ফেরদাউসের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো। চিকিৎসকরা বলেছেন যে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণে তার মৃত্যু হয়েছে।'

তবে, কী কারণে ফেরদাউসের মৃত্যু হয়েছে তার কোনো লিখিত কাগজ দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ডেথ সার্টিফিকেট ও পোস্টমর্টেমের কোনো রিপোর্ট আছে কি না জানতে চাইলে ফেরদাউসের স্ত্রী সাহেদা বেগম (৪০) জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো কাগজ দেয়নি। পরীক্ষার সব কাগজ এখনো হাসপাতালেই আছে।

অন্যদিকে একই দিনে শিয়ালের আক্রমণের শিকার হন তালুক কেওড়াবাড়ি গ্রামের লিপি বেগম (৪০)। মাঠে ছাগল নিয়ে গেলে প্রাণীটি তাকে পেছন থেকে পায়ে কামড় দিয়ে পালিয়ে যায় বলে জানান লিপি বেগম। তবে প্রাণীটি শিয়াল না অন্য কিছু সে বিষয়ে সন্দিহান তিনি।

লিপি বেগম বলেন, 'একই দিনে এই গ্রামের ৩ জনকে কামড়েছে প্রাণীটি। প্রাণীটি দেখতে শিয়ালের মতো। তবে গায়ে ডোরা কাটা দাগ আছে।'

লিপি বেগম আরও বলেন, 'এই এলাকায় ধান খেতে অনেক শিয়াল আছে। এর আগে শিয়াল আমার একটি ছাগল নিয়ে গেছে এবং আরও একটি ছাগলকে কামড়ে দিয়েছে।'

কেওড়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে দেখা হয় স্থানীয় কৃষক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। ভয়ে লাঠি হাতে তিনি বসে আছেন ধান খেতের পাশে।

শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিয়ালের আক্রমণের ভয়ে হাতে লাঠি নিয়ে ধান খেতে গিয়েছিলাম। গ্রামের সবাই খুব ভয়ে আছে। লাঠি ছাড়া কেউ জমিতে যায় না।'

পাগলা শিয়ালের আক্রমণের পর প্রায় ৫০ ভাগ শিক্ষার্থী স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। ছবি: মোস্তফা সবুজ

গ্রামের আরেক নারী সাজেদা বেগম (৪২) বলেন, 'ভয়ে-আতঙ্কে রাতে কেউ বাড়ি থেকে বের হয় না। গত ১ মাস ধরে আমরা এই বিপদে আছি। কিন্তু প্রশাসন কোনো সাহায্য করছে না। পুলিশ আসে, সাংবাদিকরা আসে। এসে কথা বলে চলে যায়। আমাদের কেউ এই বিপদ থেকে রক্ষা করে না।'

এদিকে শিয়ালের আক্রমণের ভয়ে স্কুলে আসছে না কেওড়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্কুলে গিয়ে দেখা যায় একজন শিক্ষক স্কুলের দরজা বন্ধ করে ক্লাস নিচ্ছেন।

জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, 'আমাদের বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী ১৫০ জন। পাগলা শিয়ালের আক্রমণের আগে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। কিন্তু এখন এই ঘটনার পরে প্রায় ৫০ ভাগ শিক্ষার্থী স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে ভয়ে। যারা এখন স্কুলে আসে তাদের মা-বাবারা রেখে যান এবং স্কুল শেষে আবার নিয়ে যান।'

তবে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ যারা প্রাণীটিকে আক্রমণ করতে দেখেননি, তারা বলছেন প্রাণীটি শিয়াল নয়, শিয়ালের মতো দেখতে। অনেকটা হায়েনার মতো।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ঘটনাস্থলে গিয়েছেন গাইবান্ধা জেলার প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান সরকার। ছবি: মোস্তফা সবুজ

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন গাইবান্ধা জেলার প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান সরকার।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'লোকজন ভয়ে ভিন্ন কথা বলছে। আসলে প্রাণীটি পাগলা শিয়াল। র‍্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সে মানুষের ওপর আক্রমণ করছে।'

মাসুদুর রহমান বলেন, 'শিয়ালের অন্তত ৫০টি প্রজাতি আছে। তবে এই এলাকায় কোন কোন ধরণের শিয়াল আছে তা আমাদের জানা নেই। শিয়াল সাধারণত ২ কারণে লোকালয়ে এসে হানা দেয় এবং মানুষের ওপর আক্রমণ করে। প্রথমত যদি তাদের খাদ্য সংকট দেখা দেয়, আর দ্বিতীয়ত যদি শিয়াল জলাতঙ্ক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।'

তিনি বলেন, 'এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি যে শিয়ালগুলো জলাতঙ্ক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষের ওপর আক্রমণ করছে।'

পাগলা শিয়াল বা কোনো প্রাণী কামড় দিলে গ্রামবাসীকে দ্রুত জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মাসুদুর রহমান।

এ বিষয়ে প্রশাসন গত ১ মাসে কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? জানতে চাইলে পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগামীকাল রাজশাহী থেকে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার একটি দল আসবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

'আমরা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদেরকে বলেছি যেন স্থায়ী কিছু দল তৈরি করে গ্রামবাসীর জন্য পাহারার ব্যবস্থা করে। ইতোমধ্যে গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে একটি শিয়ালকে মেরে ফেলেছে। ধান প্রায় পেকে গেছে। ধান কাটা হলে শিয়ালগুলো এমনিতেই মানুষের বসতি থেকে দূরে চলে যাবে,' বলেন ইউএনও কামরুজ্জামান।

Comments

The Daily Star  | English

Torch procession at DU demanding justice for JCD leader Shammo

The procession, under the banner of "Students Against Terrorism", began around 8:20pm

1h ago