নতুন দিনের সূচনা
মহাকালে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে কোনো জাতির জন্য, যার জন্য সে জাতির জনগণ আজীবন গর্ব করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এমনই এক মুহূর্ত চলছে এখন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার বহু আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন।
এটি শুধু সাধারণ একটি অবকাঠামোই নয়, বিশ্বের অন্যতম প্রমত্তা নদীর উপর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের এই সেতুটি প্রযুক্তিগত সাফল্য হিসেবে ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে।
এই সেতু আমাদের জাতীয় গৌরব এবং আমাদের সামর্থ্যের প্রমাণ। আরও বিশেষভাবে বলা যায়, শেখ হাসিনার মতো একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক এই সেতু।
বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অর্থদাতারা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এক দশক আগে বিলিয়ন ডলারের এই মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে এলেও, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির এ স্বপ্ন পূরণে সব সম্ভাবনাকে একত্রিত করেছেন।
৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত দোতলা এই সড়ক-রেল সেতু 'তলাবিহীন ঝুড়ি' থেকে উঠে আসা এই দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের দিকে সাহসী অগ্রযাত্রার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করবে পদ্মা সেতু। এতে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডোরের সংযোগ হিসেবে বিবেচনা করে সেতুটি দেশের জিডিপিতে প্রায় ১ দশমিক ২ শতাংশ যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পুরোপুরি চালু হলে সেতুটি বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে বিপ্লব ঘটাবে। এর মাধ্যমে ভ্রমণের সময় ও খরচ উভয়ই কমে আসবে। বাণিজ্যিক ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পথ মসৃণ করে দেবে এবং এর ফলে এ অঞ্চলের ৩ কোটির বেশি মানুষের সম্ভাবনার দুয়ার আরও খুলে যাবে।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী জাবের হাসানের গ্রামের বাড়ি খুলনায়। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন অবশেষে সত্যি হতে চলেছে। আমরা বছরের পর বছর ধরে এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।'
'সেতুটি শুধু কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত একটি মেগা কাঠামো নয়, এর সঙ্গে আমাদের আবেগ জড়িত,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'যাত্রাপথ খুবই ক্লান্তিকর ও কষ্টদায়ক হওয়ায় আমরা ইচ্ছা হলেই নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি যেতে পারি না।'
আজ সকাল ১০টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে সেতুর মাওয়া প্রান্তে জনসভায় অংশ নেবেন। এরপর তিনি সেখানে একটি ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে সেতুর উদ্বোধন করবেন এবং নামাজ আদায় করবেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী সেতু পার হয়ে জাজিরা প্রান্তে যাবেন এবং আরেকটি ফলক উন্মোচন করবেন।
পরদিন ভোর ৬টায় সেতুটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জাজিরা প্রান্তে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করছে।
উদ্বেলিত জনগণ ইতোমধ্যে গৌরবময় মুহূর্তটি দেখতে সেখানে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে সেতুর কাছে কাউকে যেতে দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
উদ্বোধনের আগের দিন থেকেই মুন্সিগঞ্জের সেতুর মাওয়া প্রান্তে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার কাছের জনসভার মাঠও প্রস্তুত হয়েছে, যেখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোকের উপস্থিতির কথা রয়েছে। পদ্মা সেতুর আদলে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে মঞ্চ।
চলমান বন্যা উদ্দীপনাকে কিছুটা ম্রিয়মাণ করলেও, দেশের সব জেলায় একযোগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উদযাপন হবে।
উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযোগকারী ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ইতোমধ্যে আলোকিত করা হয়েছে। ব্যানার-পোস্টার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে চারদিক।
পুরো পদ্মা সেতু এলাকায় নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনগণের অংশ নেওয়ার সুবিধার্থে সরকার ইতোমধ্যে এই সেতু সংযোগকারী সড়কের ১৭টি সেতুর টোল ও একটি ফেরির ভাড়া মওকুফ করেছে।
গতকাল বুয়েটের শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল সংযোগ সড়কের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো পরীক্ষা করেছে। এ উপলক্ষে ইতোমধ্যে মাওয়া-শিমুলিয়া রুটে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
অর্থায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা, পাইল ডিজাইনের জটিলতা, বন্যা ও করোনা মহামারিসহ অসংখ্য চ্যালেঞ্জ পার করে পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলো।
সব বাধা অতিক্রম করে সেতুটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তির এক অনন্য কীর্তি হয়ে রইল।
উত্তাল পদ্মা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের বিষয়টি গত শতকের ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আলোচনায় ছিল। ১৯৯৭ সালে যমুনার উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ দিকে এলে এ আলোচনা আরও সরব হয়ে ওঠে।
পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছিল ১৯৯৮-৯৯ সালে এবং সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা করা হয় ২০০৩-০৫ সালের মধ্যে।
আরও সমীক্ষা ও অর্থায়নের উৎস খোঁজা শেষে সরকার দাতাদের সহায়তায় নির্মাণ করতে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প অনুমোদন করে।
সেতুতে রেললাইন যুক্ত করায় ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি পদ্মা সেতু প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় বাড়িয়ে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা ধরা হয়।
সরকার ২০১১ সালের শুরুতে ৪টি উন্নয়ন অংশীদারের সঙ্গে ঋণ চুক্তি সম্পন্ন করে। সে বছরের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়।
কিন্তু বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটি সেপ্টেম্বর মাসেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। প্রধান দাতাসংস্থা বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে প্রতিশ্রুত ঋণ দেওয়া কার্যক্রম স্থগিত করে। পরে এ অভিযোগ অসত্য বলে প্রমাণিত হয়।
২০১২ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নিজস্ব তহবিল দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি প্রকৌশলগতভাবে দেশের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এ প্রকল্পের মূল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
বিশ্বের গভীরতম ভিত্তির এই সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। একে একে ৪২টি পিলারের উপর ৪০টি স্প্যান বসে।
প্রমত্তা পদ্মা নদী প্রচুর পরিমাণে পলি বহন করে এবং এ কারণে এ নদীর তলদেশ নরম হওয়ায় এর উপর কিছু নির্মাণ করা কঠিন। তাই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রকৌশলগতভাবে চ্যালেঞ্জিং ছিল।
নদীর প্রবল স্রোত এবং ভাঙনের কারণে নদীশাসন ও পাইলিং করা ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ।
সেতুর শেষ স্প্যান ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর বসানোর মাধ্যমে নদীর দুই পাড় সংযুক্ত হয় এবং দৃশ্যমান হয়ে ওঠে পদ্মা সেতু।
গত মাসে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করেন।
বুধবার প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতু উদ্বোধনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে।
মাদারীপুরের বাসিন্দা আশুতোষ বৈদ্দ্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন থেকে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোটে করে এই উত্তাল নদী পার হওয়ার যন্ত্রণার শেষ হতে চলেছে। এখন আমি যে কোনো সময় বাড়ি যেতে পারব।'
'একজন বাংলাদেশির জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত,' যোগ করেন তিনি।
Comments