যে নির্দেশ বাস পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না
মালিক সমিতির ঘোষণা অনুযায়ী রোববার থেকে ঢাকায় 'সিটিং সার্ভিস' ও 'গেটলক সার্ভিস' বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আরও জানানো হয়েছিল, ডিজেল ও সিএনজিচালিত প্রতিটি বাসে আলাদা স্টিকার লাগানো হবে।
কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেল চরম অরাজক চিত্র। একটি বাস দেখেও বোঝার উপায় নেই যে, সেটি 'সিটিং সার্ভিস' না 'গেটলক সার্ভিস'। প্রতিটি বাসই আগের মতো অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলছে।
রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, মানিক মিয়া এভিনিউ ও মিরপুর সড়কে সিএনজিচালিত একটি বাসেরও দেখা পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরাও সিএনজিচালিত কোনো বাস চলতে দেখেননি বলে জানান।
রাতারাতি ঢাকার রাস্তা থেকে সিএনজিচালিত বাস উঠে গেল! ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুরগামী স্বাধীন পরিবহনের একটি বাসে উঠলাম। কথা বলছিলাম বাসের চালক শাহীনের সঙ্গে। শাহীন জানালেন, তাদের মোট ৩৫টি বাস এবং সবগুলোই ডিজেলে চলে।
আগে কীভাবে চলতো? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আগের খবর জানি না।'
বাসটির সব আসন আগেই পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও ফার্মগেট মোড় থেকে খামারবাড়ি পর্যন্ত থেমে থেমে যাত্রী উঠানো হচ্ছিল। বাসের ভেতর আর কারও দাঁড়ানোরও উপায় নেই। দরজায় ঝুলছেন কয়েকজন। তখনও নিচে নেমে যাত্রী খোঁজার চেষ্টা করছিলেন চালকের সহকারী। এ নিয়ে তার সঙ্গে যাত্রীদের তর্ক বেঁধে যায়। কয়েকজন মারমুখী হয়ে উঠেন।
হঠাৎ সামনে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট দেখে চালক শাহীন চিৎকার করে সহকারীকে বাসের দরজা লাগিয়ে দিতে বলেন। কচ্ছপ গতির বাস এবার দ্রুত চলতে শুরু করল।
একটু সুযোগ পেয়ে চালকের সহকারীকে প্রশ্ন করি, রাস্তায় সিএনজিচালিত বাস নেই কেন?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চালকের সহকারী বলেন, 'মোড়ে মোড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত, মামলা দিচ্ছে, জরিমানা করছে। কম ভাড়ায় চলতে হবে, তাই মালিকেরা সিএনজিচালিত বাস নামাচ্ছেন না। সেগুলো ডিপোতেই পড়ে আছে।'
জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে বিআরটিএ'র ভ্রাম্যমাণ আদালত। একটি ছাতার নিচে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে আছেন ম্যাজিস্ট্রেটসহ কয়েকজন। তাদের সঙ্গে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একদল প্রতিনিধিও আছেন। তারা প্রায় প্রতিটি বাসকে থামিয়ে চেক করছেন। কোনো অনিয়ম-অভিযোগ পেলে মামলা দিচ্ছেন, জরিমানা করছেন।
বসুমতি পরিবহনের একটি বাসকে থামানো হলো। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট এগিয়ে গিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বললেন। গাড়ির কাগজপত্রসহ সেটি ডিজেল না সিএনজিচালিত তা পরীক্ষা করলেন। যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেয়ে ৬ হাজার টাকা জরিমানাসহ ওই বাসের বিরুদ্ধে একটি মামলা দিলেন। তবে বাসের চালক জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। তাই তাকে একদিন সময় দিয়ে মামলার টোকেনসহ বাস নিয়ে চলে যেতে বলা হলো।
এই বাসের যাত্রী আজিজুল হাকিম বললেন, 'মোহাম্মদপুর থেকে উঠেছি, যাব কাওরানবাজার। নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা, তবে আমার কাছ থেকে নিচ্ছে ১৫ টাকা।'
এই বাসেরই আরেক যাত্রী বলেন, 'আমি গুলিস্তান যাব। চার্ট অনুযায়ী ভাড়া ২৮ টাকা, কিন্তু আমার কাছ থেকে নিচ্ছে ৪০ টাকা। তাই ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে অভিযোগ করেছি।'
বিষয়টি জানতে চাইলাম বিআরটিএ'র ভ্রাম্যমাণ আদালত-৮ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ফখরুল ইসলামের কাছে।
তিনি বললেন, 'সরকার থেকে সব ঠিক করে দেওয়ার পরও এখনও কিছু কিছু অনিয়ম হচ্ছে। সিটিং সার্ভিস ও গেটলক সার্ভিস আইনগতভাবে এখন আর বৈধ নয় এবং এগুলোর চলার কোনো সুযোগ নেই। অভিযানে আমরা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলছি, অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ পেলে কখনও বাসচালক অথবা মালিক সমিতির বিরুদ্ধে জরিমানাসহ মামলা দিচ্ছি।'
'যেসব বাসে এখনও স্টিকার লাগানো হয়নি বা যেগুলোর কাছে ভাড়ার চার্ট নেই, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং চেক করে সেগুলোতে স্টিকার লাগিয়ে দিচ্ছি', যোগ করেন তিনি।
সেখানেই উপস্থিত বিআরটিএ'র পরিদর্শক জিল্লুর রহমান জানান, ঢাকার কয়েকটি স্থানে এরকম আরও ৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে।
পাশেই সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান কয়েকজনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তার কাছে জানতে চাইলাম, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার পরও এত অনিয়ম কেন?
অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বললেন, 'একদিনে তো আর সবকিছু ঠিক হয়ে যায় না। তবে আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ধীরে ধীরে সবকিছু নিয়মের মধ্যে চলে আসবে।'
আপনাদের তথ্যমতে ঢাকায় ৬ হাজার বাসের মধ্যে ১৯৬টি বাস সিএনজিতে চলে। তবে এখন রাস্তায় একটিরও দেখা নেই। অভিযোগ আছে, কম ভাড়ায় চলতে হবে, তাই মালিকেরা সিএনজিচালিত বাস রাস্তায় নামাচ্ছেন না...
মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, 'এ কারণে যদি কোনো সিএনজিচালিত বাস রাস্তায় না নামে, তাহলে আমরা সাংগঠনিকভাবে সেসব বাস মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।'
সকাল থেকেই থেমে থেমে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি কিছুটা বাড়ল। ভ্রাম্যমাণ আদালত ও মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা আশপাশে আশ্রয় খুঁজতে লাগলেন। অগত্যা চলে এলাম সেখান থেকে। পা বাড়ালাম কলাবাগানের দিকে।
সেখানে গিয়ে বিআরটিএ'র আরও একটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের খোঁজ পাওয়া গেল। এখানেও একটি যাত্রী ছাউনির নিচে ছাতা-টেবিল পেতে ম্যাজিস্ট্রেটসহ বসে আছেন কয়েকজন। তাদের পাশেই মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা জটলা করেছেন। পৌঁছেই জানতে পারলাম একটু আগেই বিকাশ পরিবহনের একটি বাসকে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে।
বিষয়টি জানতে চাইলাম বিআরটিএ'র ভ্রাম্যমাণ আদালত-৪ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফিরোজা পারভীনের কাছে।
তিনি বললেন, 'অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন না করা এবং কাগজপত্র সঠিক না থাকায় বাসটিকে আমরা ডাম্পিংয়ে পাঠিয়েছি।'
টানা ৫ দিন ধরে আপনারা অভিযান পরিচালনা করছেন। আগের তুলনায় অনিয়মের চিত্র এখন কেমন?
ফিরোজা পারভীন বলেন, 'পরিবর্তন কিছুটা হয়েছে। রাতারাতি তো আর সব পরিবর্তন হয়ে যাবে না। এখন পর্যন্ত আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমরা সেসব বাসের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং অতিরিক্ত আদায়কৃত ভাড়া যাত্রীদের ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।'
পাশেই উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির অফিস সেক্রেটারি সামদানী খোন্দকার। তার কাছে জানতে চাইলাম, মামলা-জরিমানার পরও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় থামছে না কেন?
তিনি বলেন, 'সঠিকভাবে তদারকির পরও অনেকে অনিয়ম করেন। এটি আমাদের দেশের একটি সংস্কৃতি। তবে আমাদের অভিযান চলছে। আশাকরি অচিরেই এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হবে।'
বাসচালক ও সহকারীদের অনেকের দাবি, মালিকপক্ষ থেকেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে?
এ বিষয়ে সামদানী খোন্দকার বলেন, 'এ অভিযোগ সঠিক নয়। সব বাস মালিকদের সঙ্গে আমাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে এবং আমরা সেখানে তাদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছি। সরকার অনুমোদিত চার্টের বাইরে কেউ অতিরিক্ত ভাড়া নিতে পারবে না। নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা চলমান থাকবে।'
তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ভারী বৃষ্টি শুরু হলো। পাশে তাকিয়ে আরও অবাক হলাম। ভ্রাম্যমাণ আদালতের চেয়ার-টেবিল ফাঁকা, কেউ নেই। হঠাৎ নজরে এলো, সামনে দাঁড়ানো একটি কালো প্রাইভেটকারের জানলা নামাতে নামাতে কাউকে কিছু একটা বলে চলে গেলেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফিরোজা পারভীন। বোঝা গেল ভ্রাম্যমাণ আদালত-৪ এর অভিযান সেদিনের মতো এখানেই সমাপ্ত।
কলাবাগান থেকে ফেরার পথে বিকাশ পরিবহনের একটি বাসে উঠি। এতে উঠেই দেখা যায়, ভাড়া নিয়ে চালকের সহকারীর সঙ্গে তর্ক চলছে যাত্রীদের।
মো. হাসান নামের এক যাত্রী নিউমার্কেট থেকে উঠেছেন, নামবেন খামারবাড়ি। চার্টে লিখিত ভাড়া ১১ টাকা, কিন্তু তার কাছে ২৫ টাকা ভাড়া চেয়েছেন সহকারী। এ কারণে সহকারীর সঙ্গে তার বেশ কিছুক্ষণ বাদানুবাদ হয়। শেষে অন্য যাত্রীদের প্রতিবাদের মুখে হাসানের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে পারেননি সহকারী।
ওই বাসেরই আরেক যাত্রী রেহানা বেগম বলেন, 'আমি প্রায় প্রতিদিন সংসদ ভবনের সামনে থেকে বিকাশ অথবা ভিআইপি পরিবহনে করে কাকলী যাই। চার্টের ভাড়া ২১ টাকা হলেও আমার কাছ থেকে প্রতিদিন তারা ৩০ টাকা করে নেয়।'
'বেশি ভাড়া না দিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। বাসের লোকজন একরকম জোর করেই আমাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে। শুধু আমরাই না, এদের কাছে সারাদেশের মানুষই জিম্মি', বলেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিকাশ পরিবহনের বাসচালক জামাল বলেন, 'আমাদের বাস ওয়েবিল সিস্টেমে চলে। তাছাড়া রাস্তায় চেকার আছে, তাদেরকেও টাকা দিতে হয়। এ কারণেই বেশি ভাড়া নেই।'
Comments