ত্বকীর বাবা বিচার চান, প্রীতির বাবা চান না– তাৎপর্য কী?

সামিয়া আফনান জামাল প্রীতি ও তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ছবি: সংগৃহীত

কার শাস্তি চাইব? বিচার নাই, বিচার কার কাছে চাইব— কথাগুলো দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত সামিয়া আফনান জামাল প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিনের।

স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে গত ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন কলেজছাত্রী প্রীতি (২২)। তখন সন্তান হারানোর শোকে কাতর সামিয়ার মাও বলেছিলেন, 'বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ আমাকে পৌঁছে দিলেই হলো।'

সন্তান হত্যার বিচার না চাওয়ার এমন আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর। সেদিন রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে খুন হন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন (৪৩)। নিহত দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক। ছেলে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ, হতাশ এই বাবাও সেদিন বলেছিলেন, 'আমি কোনো বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক।'

এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে– কতটা কষ্ট ও হতাশা বুকে চাপা দিয়ে কোন পরিস্থিতিতে কোনো বাবা-মা সন্তান হত্যার বিচার চাইতে অপারগতা প্রকাশ করেন?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক ও আরেক সন্তান হারানো পিতা নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির সঙ্গে।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ অপহরণের ২ দিন পর রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা-খাল থেকে। এর এক বছর পর সংবাদ সম্মেলন করে কোথায়, কার নির্দেশে, কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছিল তার বিস্তারিত জানিয়েছিল মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। কিন্তু আজও এই আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। তবু ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি প্রতি মাসের ৮ তারিখে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আজও মোমবাতি জ্বালিয়ে যাচ্ছেন।

তাহলে ত্বকীর বাবার বিচার চাওয়া আর প্রীতির বাবা-মায়ের বিচার না চাওয়ার তাৎপর্য কী?

ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপচারিতায় আবুল কাসেম ফজলুল হক ও রফিউর রাব্বি ২ জনই বলেছেন, বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে প্রীতির বাবা-মায়ের এই অপারগতা দেশের বিচার ও রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আস্থাহীনতার বিষয়টিকেই প্রকট করে তুলেছে। তারা হয়তো উপলব্ধি করেছেন- এসব ঘটনার ক্ষেত্রে যে বিচার হয় না, সেটাই এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। উপরন্তু বিচারপ্রার্থীকে নানা হয়রানির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এমন একটি বিপন্ন বোধ থেকেই তারা হয়তো সন্তান হত্যার বিচার চাননি।

এ বিষয়ে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, 'দীপন হত্যার বিচার হয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রায় সাড়ে ৫ বছরের মাথায়। অন্য ১০টা ঘটনা দেখলে মনে হবে এটা হয়তো তাড়াতাড়িই হলো। এমন অনেক ঘটনার বিচার অগ্রসর হয় না। পুলিশ চার্জশিট দিতেই অনেক দেরি করে। পার হয়ে যায় ৫-৭ বছর।

'আমার মনে হয়, এই যে দীর্ঘদিন ধরে বিচার হয় না, লেগে থাকতে হয়, উকিলকে টাকা দিতে হয় এবং বিচার কবে হবে, কী হবে- এসব অনিশ্চয়তাই "বিচার চাই না" এই কথাটা বলার পেছনের প্রধান কারণ।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'কেউ মারা গেছে মানে, তার জন্য বাবা-মা কিংবা ভাই-বোন যারাই হোক, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবেও। বিচার চাইতে গিয়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। মানসিক দিক দিয়েও বিপন্ন হতে হয়। টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়। নিম্ন আদালতে রায় হলেও হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট হয়ে কতদিন লাগে কে জানে। তো এমন দীর্ঘ সময় ধরে যদি বিচার চলে, তাহলে এটাকে আইনের শাসন বলা যায় না।'

এসময় ত্বকী হত্যার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'গোটা জাতি জানছে ব্যাপারগুলো। কারা অপরাধী এটাও জানছে। তার পরেও বিচার আরম্ভ হয় না। শুরু হলে শেষ হয় না।

'যারা একটু ক্ষমতায় সঙ্গে যুক্ত থাকেন, দুর্ব্যবহার করেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। লোকে সেটা নীরবে সহ্য করে। আমরা যাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি কথা বলি, তারা তো সমাজের অনেকটা উপরের স্তরের লোক। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ তো এর চেয়ে অনেক নিচের দিকে। সেই জায়গায় যারা একটু বোঝে, কিংবা চিন্তা করে তারা খুব নিরাপত্তার অভাব বোধ করে, অসহায় বোধ করে।'

আর বিদ্যমান সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এই লেখকের পর্যবেক্ষণ হলো, 'হত্যা-ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোকে আমাদের সমাজ সহ্য করছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমাজ খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে আছে।'

এদিকে, প্রীতির বাবা-মায়ের বিচার না চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে রফিউর রাব্বি বলেন, 'প্রকৃত অর্থে এটি এই বিচারব্যবস্থা, বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের ক্ষোভ, ঘৃণা ও আস্থাহীনতার প্রকাশ।

'তারা আসলেই সন্তান হত্যার বিচার চান না, বিষয়টি সেরকম না। তারা বিচার চান হয়তো। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার প্রতি তারা আস্থাশীল না। এ জন্যই তারা হয়তো এমনটা বলেছেন। আর কেন আস্থাশীল না, সেটা তো আমরা পদে পদে উপলব্ধি করছি।'

রফিউর রাব্বির পর্যবেক্ষণ, 'আমাদের বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণই নিয়ন্ত্রিত। রাজনৈতিকভাবে এটা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। চাঞ্চল্যকর যে হত্যাকাণ্ডগুলো এ পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছে, তার কিছুর বিচার হয়েছে। কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।  যেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে তাও রাজনৈতিক কারণে। আবার যেগুলোর বিচার হয়েছে সেগুলোর পেছনেও রাজনৈতিক কারণ আছে।'

তবে গত ৯ বছর ধরে সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে যাওয়া এই পিতার ভাষ্য, 'ক্ষোভ হলেও, অভিমান হলেও আমি বলব বিচার চাইতে হবে। এই জন্য যে, শাসকগোষ্ঠী যারা রয়েছে, তাদের যে চেহারা, নির্মমতা, বর্বরতা– এটাকে উন্মোচন করার জন্য বিচার চাইতে হবে। বার বার চাইতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

UN report on mass uprising: What lies ahead for AL?

Find out more with Tanim Ahmed in today's Star Explanations

1h ago