ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে টোল: আধুনিক সড়কে পুরোনো ব্যবস্থাপনা
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ২০২০ সালের মার্চে। এরপর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) এই এক্সপ্রেসওয়েতে স্বয়ংক্রিয় টোল আদায় ব্যবস্থা চালু করার জন্য ২ বছরেরও বেশি সময় পেয়েছে।
তবে, গত সপ্তাহে সওজ কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশনের (কেইসি) নেতৃত্বে একটি যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয় টোল আদায়ের জন্য। গত শুক্রবার থেকে প্রতিষ্ঠানটি ম্যানুয়ালি টোল আদায় শুরু করে। এর ফলে এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজায় তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট।
৪টি প্রবেশ ও বাহির হওয়ার পথে টোল বুথ চালু না করেই টোল আদায় শুরু হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা-পদ্মা সেতু অংশের জন্য মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী সেতুর কাছে এবং পদ্মা সেতু-ভাঙ্গা অংশের জন্য ফরিদপুরের ভাঙ্গায় টোল আদায় করা হচ্ছে।
এর ফলে, ব্যবহার না করলেও একটি অংশের পুরোটা ব্যবহারের সমান অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে চালকদের। একইভাবে, টোল প্লাজার আগেই যারা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নেমে যাচ্ছে তাদের কাছ থেকে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সওজ।
এ ছাড়া, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করেই এই টোল আদায় শুরু হয়েছে। ফলে চালকরা টোল প্লাজায় কর্মচারীদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং অন্যান্য গাড়ি চলাচলে দেরি করিয়ে দিচ্ছেন।
যদিও গতকাল ও আজ এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে ঈদ যাত্রার সময় যানজট বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছেন এই এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারকারীরা।
সে ক্ষেত্রে, ঈদের ছুটিতে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের যাত্রীরা বিপাকে পড়তে পারেন। পদ্মা সেতুর কারণে বেশ কয়েকটি জেলায় যাতায়াতের জন্য ২-৩ ঘণ্টা সময় কম লাগছে। এরই সঙ্গে ফেরির জন্য অপেক্ষা করার বিষয়ে অনিশ্চয়তার অবসান হয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষও (বিবিএ) পদ্মা সেতু ব্যবহারের জন্য স্বয়ংক্রিয় টোল আদায় ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি। এর জন্য আরও অন্তত ৬ মাস লাগতে পারে বলে জানান সেতু কর্মকর্তারা।
বিশ্বে স্বয়ংক্রিয় টোল ব্যবস্থা ছাড়া এক্সপ্রেসওয়ে বিরল জানিয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে সওজ ও বিবিএর পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে আধুনিক অবকাঠামো। আমরা যদি এখানে আধুনিক অপারেটিং সিস্টেম চালু করতে না পারি, তাহলে জনগণ তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবে না।'
ম্যানুয়াল অপারেশন
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি একনেক সভায় জাতীয় মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহন থেকে টোল আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালের মার্চে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক' যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ৫৫ কিলোমিটার মহাসড়কটি ১১ হাজার ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়। এটি ছিল দৈর্ঘ্যের হিসাবে ব্যয় বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল রাস্তা।
২০২১ সালের এপ্রিলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের একটি ঘোষণার পর অর্থ মন্ত্রণালয় অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য প্রতি কিলোমিটারে ১০ টাকা টোল হার (বেইজ টোল) অনুমোদন করে। সেই সময় সড়ক কর্তৃপক্ষ গত বছরের জুলাই থেকে টোল আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
তবে টোল আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো প্রস্তুত না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
গত বছরের আগস্টে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটি এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায়ের জন্য কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশনকে নিয়োগ দেওয়ার একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে।
সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির মাধ্যমে একটি কেইসি-নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হলেও, দীর্ঘ সময় পর গত ২৯ জুন সওজ তাদের সঙ্গে ৫ বছরের চুক্তি করে।
চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি প্রথম ৬ মাসের জন্য ম্যানুয়ালি টোল আদায় করবে। গত শুক্রবার তারা কাজ শুরু করার পর টোল প্লাজায় আসা গাড়ি ধলেশ্বরী ও ভাঙ্গায় ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ সারি তৈরি করে।
সমস্যা কোথায়?
বর্তমানে ধলেশ্বরী সেতুর কাছে এবং ভাঙ্গার টোল প্লাজাগুলোতে উভয় দিকে ৬টি করে মোট ১২টি করে বুথ রয়েছে।
আব্দুল্লাহপুর, শ্রীনগর, পুলিয়াবাজার ও মালিগ্রামে প্রবেশ ও প্রস্থানের সময় টোল প্লাজা থাকবে।
ওই পয়েন্টগুলোতে বুথ রয়েছে, তবে সেগুলো এখনও টোল সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত নয় বলে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারা।
যোগাযোগ করা হলে সওজের নারায়ণগঞ্জ সার্কেলের সুপারিন্টেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল হক জানান, টোল আদায়ের জন্য ৩টি ব্যবস্থা থাকবে। একমুখী ৬টি বুথের মধ্যে ২টি বুথে ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ইটিসি) সিস্টেম থাকবে, ২টি বুথে টাচ-অ্যান্ড-গো সিস্টেম থাকবে এবং বাকি ২টি বুথ ম্যানুয়ালি পরিচালিত হবে।
ইটিসি সিস্টেম রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে যানবাহন শনাক্ত করে এবং সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যবহারকারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টোলের অর্থ কেটে নেয়। এ কারণে, এই পদ্ধতিতে টোল পরিশোধের জন্য যানবাহন থামানোর প্রয়োজন হয় না।
টাচ অ্যান্ড গো সিস্টেমে চালকরা একটি কার্ড কিনে নেন, যা টোল প্লাজায় একটি মেশিনে সোয়াইপ করতে হয়। প্রক্রিয়াটি কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় নেয় না।
নাজমুল হক জানান, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে ৬ মাসের মধ্যে এই সিস্টেমগুলো চালু করতে হবে।
গত বুধবার চুক্তি সইয়ের পর দ্য ডেইলি স্টার সওজের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠানের কাছে জানতে চায়, চুক্তি সই করতে এত দেরি কেন হয়েছে এবং কেন ম্যানুয়ালি টোল আদায় করা হচ্ছে?
এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা তো বসে ছিলাম না। পদ্ধতি অনুসরণ করে দরপত্র আহ্বান করেছি, টোল সংগ্রহের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছি। যদিও আরও ভালো প্রস্তুতির সুযোগ ছিল, কিন্তু তার জন্য সকল কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হবে ব্যাপারটা এমন নয়।'
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আরও বেশি টোল বুথ না থাকলে ঈদের ভিড়ের সময় যান চলাচলে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে।
তিনি আরও বলেন, টোলের বিষয়ে আরও বেশি প্রচারণা দরকার, যাতে এই মহাসড়ক ব্যবহারকারীরা আগে থেকেই এ বিষয়ে সচেতন হন।
Comments