জোড়াতালি দিয়ে কোভিড মোকাবিলা, নেই কোনো রোডম্যাপ

স্টার ফাইল ছবি

করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলার জন্য সরকারের এখন পর্যন্ত কি কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা আছে? সত্যিকার অর্থে নেই।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথমবারের মতো করোনার প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এটা মোকাবিলার জন্য নানা উদ্যোগ নেয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভাইরাস নির্মূলের জন্য সে সময়েই চীন, নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সিঙ্গাপুর, হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়া ভাইরাস দমনের জন্য কর্কশ লকডাউন এড়িয়ে প্রচুর পরীক্ষা, ট্রেসিং ও বিচ্ছিন্নকরণের পথ বেছে নেয়। এ ছাড়া, ইউরোপের দেশগুলো ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত উন্মুক্ত রেখে পর্যায়ক্রমিক লকডাউনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

ভ্যাকসিন আসার আগে এই কৌশলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর ছিল নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান ও চীনের নেওয়া ‘জিরো কোভিড’ পদ্ধতি।

তবে, বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হলো, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সবকিছু করা হচ্ছে সাময়িক ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে।

মহামারি ঠেকাতে সরকারের যে প্রচেষ্টা, তাতে সক্রিয়তার চেয়ে প্রতিক্রিয়াশীলতাই বেশি। সামাজিক সংক্রমণ কমিয়ে আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পর্যাপ্ত পরীক্ষা ও ট্রেসিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রেই সরকারের ঝোঁক বেশি।

এর পাশাপাশি সরকারের ভাষ্য হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে জনমানুষের উদাসীনতার জন্য বিধিনিষেধ কার্যকর হচ্ছে না। সেই সঙ্গে ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতার জন্য টিকাদান কর্মসূচিও চলছে ধুঁকে ধুঁকে।

এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণ কমে আসে এবং টিকা হাসপাতালের ওপর চাপ কমায়। সুতরাং কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রকে সবচেয়ে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদের ভাষ্য, কোভিড পরিস্থিতি প্রতিরোধে কোনো রোডম্যাপ দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এর বদলে সরকার কেবল প্রতিকারের পথ অবলম্বন করছে।

উদাহরণ হিসেবে অধ্যাপক বে-নজির বলেন, ‘সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মুখে সরকার জুলাইয়ের শুরু থেকে চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এজন্য নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এই পরিচালকের বক্তব্য, ‘সরকারের তরফ থেকে আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য দেখতে পাচ্ছি না। তারা কখন এবং কীভাবে সংক্রমণ কমিয়ে আনতে চায়? এ ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের জন্য পরিকল্পনা কী? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কবে খুলবে? এর কোনো কিছুই নেই। সব কিছু করা হচ্ছে সাময়িক ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে।’

অধ্যাপক বে-নজির আরও বলেন, ‘সরকার যেভাবে একইসঙ্গে জীবন ও জীবিকার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তাতে সংক্রমণ কমবে না। বরং স্বাভাবিকতার পথে ফিরে আসার বিষয়টি আরও প্রলম্বিত হবে।’

কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতে, সংক্রমণ ঠেকাতে আজ (গতকাল) পর্যন্ত সরকারে সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে নানা পরামর্শ দিয়েছি। তবে, সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে। আমরা কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারি না। তবে সরকারকে সেটা করতে হবে। আমরা কেবল সেগুলোর ব্যাপারে মতামত দিতে পারি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলামের ভাষ্য, সরকার পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মহামারির ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উত্থানের আগেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

গত মাসে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি প্রতিবেদনে দেশে সামাজিক পরিসরে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি উঠে আসে।

যদিও এপ্রিল-মে মাসে একটি জোরালো অভিঘাতের পর সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিল, জুনের শুরুতে তা আবার বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে যা ১৪ শতাংশের বেশি। কোনো কোনো জেলায় এই হার প্রায় ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া, অন্তত ৫০টি জেলা এখন উচ্চ ঝুঁকির এলাকায় পরিণত হয়েছে।

ভারতেও এপ্রিল-মে মাসে কোভিড সংক্রমণের এমন ঊর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছিল। যখন দৈনিক সংক্রমণ ৩৫ লাখ ছাড়িয়েছিল। তবে, কঠোর লকডাউন ও গণটিকার কারণে সেখানকার পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। গত সপ্তাহ জুড়ে সেখানে দৈনিক সংক্রমণ ৫০ হাজারের আশপাশে আছে।

বিপরীতে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে জনসাধারণের উদাসীনতা অব্যাহত আছে। সরকার আরোপিত বিধিনিষেধ কেবল কাগজে-কলমে। আর টিকার অপ্রতুলতার কারণে গণটিকা কর্মসূচিও খাবি খাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বুধবার পর্যন্ত মাত্র ৪২ লাখ ৯৮ হাজার ৩৩২ জন মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন।

কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ যদিও বলছেন, চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শপিং মল বন্ধ রাখার মতো কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সরকারের আছে।

তবে তার ভাষ্য, ‘কিন্তু এটা সত্য যে, সংক্রমণ থামানোর জন্য কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।’

শহীদুল্লাহ আরও বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে দেখা গেছে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই দেশগুলো বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। আমরাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছি। হ্যাঁ, সেগুলো কখনো কাজ করেছে। আবার ভুল কৌশল, দুর্বল সমন্বয় ও উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ত্রুটির জন্য কখনো সেগুলো কাজ করেনি।’

মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য, টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সুনির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা ছিল। তবে, ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতি পড়ায় তা বিঘ্নিত হয়।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
Tamim Iqbal

Tamim announces retirement from international cricket, again

Bangladesh's star opener Tamim Iqbal announced his retirement from international cricket through a post from his official Facebook page today.

7h ago