৭ দিনে আলুর দাম কেজিতে বেড়েছে ৯ টাকা
গত ২ সপ্তাহ আগেও মুন্সিগঞ্জ বাজারে কেজিপ্রতি আলুর দাম ছিল ১২-১৩ টাকা। আর আজ শুক্রবার খুচরা বাজারে ভোক্তা কেজিপ্রতি আলু ২৪-২৫ টাকায় কিনছেন।
কৃষকদের বাড়িতে সংরক্ষণ করা আলু কেজিপ্রতি ১৬-১৭ টাকায় কিনে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ১৮-১৯ টাকায় বিক্রি করছেন বেপারিরা। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ২৪-২৫ টাকায়। অথচ ৭ দিন আগেও খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি আলু বিক্রি হয়েছিল ১৬ টাকায়।
এবার আলু রোপণের কিছুদিন পর বৃষ্টি হওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ বছর আলু আবাদে দ্বিগুণ খরচ হওয়ায় লাভজনক দামের জন্য হিমাগার থেকে আলু বের করছেন না কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। ফলে বাজারে সরবরাহক কমে যাওয়ায় আলুর দাম বেড়েছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৭ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে আবাদ হয়েছে ৩৫ হাজার ৭৯৬ হেক্টর জমিতে। এ বছর জেলায় প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি।
মুন্সিগঞ্জ শহর বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. স্বপন মিয়াঁ জানান, আজ বাজারে আলু ২৪-২৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। গত ৭ দিন আগে যা ছিল কেজিপ্রতি ১৬-১৮ টাকা। আর গতকাল যা ছিল ২০-২২ টাকা।
'নারায়ণগঞ্জ হিমাগার থেকে ১৮ টাকা কেজিপ্রতি আলু কিনে এনে বিক্রি করছি। এর সঙ্গে পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক খরচ আছে', বলেন তিনি।
শহরের শ্রীপল্লী এলাকার সবজি বিক্রেতা আলাউদ্দিন হোসেন বলেন, 'স্থানীয় হিমাগার থেকে আলু বের না হওয়ায় আড়ত থেকে সংগ্রহ করেছি। কৃষকরা বাসাবাড়িতে যেসব আলু সংরক্ষণ করে রেখেছিল, তারা আড়তদারদের কাছে বিক্রি তা করছে। কৃষকের কাছ থেকে ১৬-১৭ টাকা কেজিপ্রতি আলু কিনে করে ব্যবসায়ীরা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ১৮-১৯ টাকা দরে বিক্রি করে।'
মুন্সিরহাট বাজারের আড়তদার হানিফ মৃধা বলেন, 'ক্রেতারা আলু পাচ্ছে না। বাড়িতে সংরক্ষণ করা আলু আর ১৫-২০ দিন পর শেষ হয়ে যাবে। পাইকারি বাজারে এক সপ্তাহ আগেও ২-৩ টাকা কম ছিল কেজিপ্রতি আলুর দাম। কিন্তু আলুর সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছে। মুন্সিরহাট বাজারে প্রতিদিন ৫০ কেজির ৫০০ বস্তা আলু বিক্রি হয়। আর বাসায় সংরক্ষণ করা আলুর চেয়ে হিমাগারের আলুর দাম বেশি হয়। কিন্তু দাম লাভজনক না হওয়ায় হিমাগার থেকে আলু বের হচ্ছে না।'
মুন্সিগঞ্জ শহরের কদম রসূল হিমাগারের ব্যবস্থাপক প্রশান্ত কুমার মণ্ডল দুলাল জানান, সম্প্রতি একটি হিমাগার থেকে কেজিপ্রতি ১৬ টাকা ৫০ পয়সা দরে আলু বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এ দামে আলু বিক্রি করলে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হবে। আলু রোপণের এক সপ্তাহ পর কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতে আবাদের ক্ষতি হয়েছিল। ফলে কৃষকদের ২ দফায় বীজ রোপণ কর হয়েছিল। যে কারণে খরচও হয়েছে দ্বিগুণ।
তিনি আরও জানান, এ ছাড়া আলু হিমাগার থেকে বের হতে আরও ২-১ সপ্তাহ লাগবে। কারণ অন্যান্য বছর জুনের মাঝামাঝি সময় আলু বের হয়ে থাকে।
শহরের হামিদপুর গ্রামের কৃষক কামরুল হাসান রাসেল বলেন, 'প্রথম দফা রোপণের পর বৃষ্টিপাতের কারণে আলু নষ্ট হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয় দফায় আলু আবাদের কারণে খরচ দ্বিগুণ হয়। জমিতে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১৫ টাকা। তারপর হিমাগারে রাখার পর কেজিপ্রতি আলু ১৮-১৯ টাকা হয়। বর্তমান বাজারে হিমাগারে কেজিপ্রতি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৬-১৭ টাকায়। লোকসানের ভয়ে হিমাগার থেকে আলু বের করছি না। আর যারা প্রথম দফা আবাদ করেছে, তাদের কেজিপ্রতি আলু ১০-১২ টাকা উৎপাদন খরচ হয়েছে। এক একর জমিতে প্রায় ৩০০ মণ আলু আবাদ হয়েছে। যেখানে হওয়ার কথা ছিল ৪৫০ মণ।'
'হিমাগার থেকে আলু বের করার উপযুক্ত সময় এখনো হয়নি। আরও ২-৩ সপ্তাহ সময় লাগবে', যোগ করেন তিনি।
কৃষক আওলাদ হোসেন বলেন, 'উৎপাদন খরচ উঠলেই আলু হিমাগার থেকে বের করব। এখন আলুর বাজারে সিন্ডিকেট নেই। আলু যখন ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়, তখন তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তখন আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে। গত বছর উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি ১১-১২ টাকা ছিল। কিন্তু এ বছরের বৃষ্টির কারণে খরচ বেড়েছে।'
হিমাগারে আলু রাখা ব্যবসায়ী রশরাজ মাদবর বলেন, 'হিমাগারে ২০-২২ টাকা কেজিপ্রতি আলু বিক্রি করতে না পারলে লোকসান গুনতে হবে। কৃষকের কাছ থেকে ৫০ কেজি আলু ৪৫০-৫০০ টাকায় কিনেছি। হিমাগার ভাড়াসহ যা কেজিপ্রতি ১৮ টাকা হয়েছে। কিন্তু কেজিপ্রতি ১৭ টাকায় আলু বিক্রি হওয়ায় লোকসানের জন্য হিমাগার থেকে বের করছি না।'
মাকহাটি গ্রামের কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, '৩২০ শতাংশ জমিতে আলু আবাদ করেছিলাম। এক শতাংশ জমিতে আলু আবাদে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। এক শতাংশ জমিতে ৩ মণ আলু হয়। বৃষ্টির কারণে ২ বার জমিতে আলু রোপণ করেছি। তারপর ১ হাজার ৬০০ টাকা বস্তা বীজ আলু কিনতে হয়েছে। প্রায় ৩ লাখ টাকার আলু বিক্রি করেছি। কিন্তু সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ হয়েছে ৬ লাখ টাকা। ১৫ দিন আগে প্রতি কেজি আলু ১০-১১ টাকায় বিক্রি করেছি কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে।'
ক্রেতারা বলছেন, হিমাগারের আলু বাজারে আসা শুরু হয়নি। যখন আসা শুরু হবে, তখন দাম আরও বাড়বে। কারণ তখন হিমাগারগুলোই আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। সবজিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত আলু বাজার ক্রেতার জন্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য মনিটরিং প্রয়োজন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. খুরশীদ আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হিমাগারে মজুত করা আলুর ২০ শতাংশ কৃষকের। আর বাকি ৮০ শতাংশ আলু ব্যবসায়ীদের। হিমাগারে ১৭ টাকা কেজিপ্রতি আলু বিক্রি করলেও হতাশ হওয়ার কারণ নেই। ব্যবসায়ীরা এখানে বেশি লাভের আশায় আলু হিমাগার থেকে বের করছে না।'
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয়ের জেলা বাজার অনুসন্ধানকারী এ বি এম মিজানুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় ৩ সপ্তাহ আগে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি আলু ১০-১২ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। তারপর প্রায় এক সপ্তাহ আগে কেজিপ্রতি আলু বিক্রি হয় ১৬-১৮ টাকায়। দুইদিন আগে ২০-২২ টাকায় কেজিপ্রতি আলু বিক্রি হচ্ছিল।'
'আলুর দাম বাড়ার পেছনে ২টি কারণ আছে। প্রথমত, কৃষক বাসায় যে পরিমাণ আলু সংরক্ষণ করে রেখেছিল, তা শেষ পর্যায়ে। দ্বিতীয়ত, হিমাগার থেকে আলু বের হচ্ছে না। ফলে বাজারে আলুর সরবরাহ কমে গেছে', বলেন তিনি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মুন্সিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আসিফ আল আজাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলুর দাম বাড়ার বিষয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাইনি। বাজারে আলুর সরবরাহ পর্যাপ্ত আছে। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করাসহ এসব বিষয় দেখা হচ্ছে।'
Comments