বুড়ি তিস্তায় পানি না থাকায় সেচ প্রকল্প ব্যাহত, বোরো চাষিদের হাহাকার
নীলফামারী জেলার বুড়ি তিস্তাসেচ প্রকল্পের জলাধার পানিশূন্য হয়ে পড়ায় এর আওতায় ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার হাজারো কৃষক বোরো খেতে সেচ দিতে পারছেন না। জেলা পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির এ সিদ্ধান্তের কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বুড়ি তিস্তা নদীর উপর প্রকল্পের ব্যারেজেটির আশেপাশে বসবাসকারী কয়েকজন প্রভাবশালীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জলাধার থেকে পানি বের করার সিদ্ধান্ত হয়।
কয়েক মাস আগে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে তারা জানান যে ব্যারেজের মুখে প্রকল্পের বিশাল জলাধারটি দীর্ঘদিন ধরে খনন না করায় সেটির তলদেশ উঁচু হয়ে ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এতে এর পানি উপচে ৭-৮ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোর ফসলের খেত ও বসতঘর পানিতে ডুবে যাচ্ছে।
আবেদনকারীরা ব্যারেজের ১৪টি গেট খুলে দিয়ে জলাধারের পানি বের করে দিয়ে এর তলদেশ খনন করার আহ্বান জানান।
পরে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে জেলা পানিসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে জলাধার থেকে পানি বের করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নীলফামারী ডিভিশন বোরো চাষিদের সেচ সুবিধা দেওয়ার স্বার্থে জলাধারের পানি বের না করার পক্ষে মত দিয়েছিল।
ব্যারেজের আশেপাশের ফসলি খেত ও বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার দাবিও নাকচ করে পাউবো।
পরে প্রকল্পের কয়েক হাজার উপকারভোগী বোরো চাষি সম্মিলিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবেদনে নিরবিচ্ছিন্ন সেচের দাবি জানান।
কিন্তু এ দাবি উপেক্ষা করে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বাধীন জেলা পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটি ব্যারেজ গেট খুলে জলাধারের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি বের করে দিতে শুরু করে।
পাউবো সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানায়, কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জলাধার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি বের করে দেওয়ার পর তাদের কর্মচারীরা ব্যারেজের গেট বন্ধ করতে গেলে, প্রভাবশালীদের ইন্ধনে দুর্বৃত্তরা তাদের মারধর করে। এতে গেট বন্ধ না হওয়ায় ক্রমাগত পানি বের হয়ে জলাধারটি পানিশূন্য হয়ে সেচ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাউবো নীলফামারী ডিভিশনের পক্ষ থেকে ডিমলা থানায় একটি অভিযোগও করা হয়।
বুড়ি তিস্তাসেচ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত কৃষকদের অভিযোগ, ব্যারেজ এলাকার চারপাশে বসবাসকারী প্রভাবশালীরা দাবি করে যে প্রকল্পের জলাধারটির ১২১৭ একর জমির মালিক তারা। তারা বল প্রয়োগ করে সেই জমিগুলোতে ফসল চাষ ও অবকাঠামো নির্মাণ করার চেষ্টা করে।
এসব ঘটনায় পাউবো সংশ্লিষ্ট থানায় একাধিক মামলাও করেছে বলে সূত্র জানায়।
পাউবো প্রকল্পের অন্তর্গত কৃষি সম্প্রসারণ শাখার কর্মকর্তা রাফিউল বারী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বুড়ি তিস্তাসেচ প্রকল্পটি দেশের সর্বপ্রথম এ ধরনের প্রকল্প যা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ওয়াপদা ১৯৬২ সালে বাস্তবায়ন করে এবং এখনো এটি সফলভাবে চলমান।
ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলায় অবস্থিত এ প্রকল্প এলাকায় ৫ দশমিক ৫০০ একর জমি এর সেচ সুবিধার আওতাধীন। এতে ৮ হাজার ৫০০ কৃষক পরিবার সরাসরি উপকৃত হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ব্যারেজের সম্মুখভাগে অবস্থিত জলাধারটি পানিশূন্য হওয়ায় গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর বিস্তীর্ণ এলাকায় দখলদাররা ধান, গম, ভূট্টাসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করছে। কোথাও অবকাঠামো নির্মাণ কাজও চলছে।
সম্প্রতি অশনীর প্রভাবে ৩ দিনের বৃষ্টিতেও বুড়ি তিস্তাসেচ প্রকল্পের জলাধারে সেচ দেওয়া যায় এমন যথেষ্ট পানি জমেনি।
বুড়ি তিস্তাসেচ ব্যবস্থাপনা কৃষক কমিটির সভাপতি এস আর শফিক সাদিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলা পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটি একটি দুষ্ট চক্রের দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ায় সেচ প্রকল্পের ৮ হাজার ৫০০ কৃষক আজ সেচবঞ্চিত হয়ে দিশেহারা। প্রকল্পের সেচ বন্ধ থাকায় আমরা বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যের ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার করছি।'
জলঢাকা উপজেলার খারিজা গোলনা গ্রামের সেচসুবিধা বঞ্চিত কৃষক রশিদুল ইসলাম বলেন, 'এতে উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। প্রকল্পের সেচে খরচ হতো এর দশভাগের একভাগ।'
প্রকল্পের জলাধার থেকে পানি নিষ্কাশন করে আশেপাশের এলাকা রক্ষা করতে জেলা পানিসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দেওয়ার আবেদনকারীদের একজন বাদল মিয়া স্বপন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরাও চাই সেচ প্রকল্প চালু থাকুক। এটা কৃষকদের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু আমরা চাই প্রকল্পের কথা বলে আমাদের যে জমি সরকার নিয়ে নিলো, তার একটা সুরাহা হোক।'
জানতে চাইলে পাউবোর প্রকল্প এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইবনে সাইদ শাওন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের কারণে প্রকল্পের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই চক্রটির উদ্দেশ্য জলাধারসহ প্রকল্পের বিস্তীর্ণ জমি গ্রাস করা।'
'অশনীর প্রভাবে গত ৩ দিনের বৃষ্টিতেও সেচ দেওয়ার মতো যথেষ্ট পানি প্রকল্পের জলাধারে জমেনি' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মূলত বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে ধেয়ে আসা পানি সংরক্ষণ করেই এ প্রকল্পের আওতায় জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হয়।'
পাউবো নীলফামারী ডিভিশনের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আব্দুল হান্নান প্রধান ডেইলি স্টারকে জানান, 'বুড়ি তিস্তাসেচ প্রকল্পটির অমিত সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে সরকার এর উন্নয়ন ও বিস্তৃতির জন্য একটি নতুন প্রকল্পে ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন যার কাজ চলমান।'
নীলফামারী জেলায় নতুন যোগদানকৃত জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টির খোঁজখবর নিচ্ছি। কৃষকদের সেচ প্রাপ্যতা অতীব জরুরি। তাদের স্বার্থে আমি শিগগির যথাযথ ব্যবস্থা নেবো।'
Comments