করোনায় করুণ সিনেমা হল কর্মীদের জীবন
আগে থেকেই ধুঁকতে থাকা দেশের চলচ্চিত্র শিল্প কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে থমকে আছে। এ সময়টাতে যেনো চলচ্চিত্রের কোনো করুণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে সিনেমা হল কর্মী আতাউর রহমানের জীবন।
রাজধানীর ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের প্রজেক্টর অপারেটর তিনি। করোনায় হল বন্ধ থাকায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বেতন পাচ্ছেন না। তবুও গত তিন দশক ধরে তার জীবন ও জীবিকা হয়ে থাকা চলচ্চিত্র শিল্প ছেড়ে যাননি।
সিনেমা প্রদর্শন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর থেকে বেঁচে থাকার জন্য দিনমজুরের কাজ শুরু করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না ৫০ বছর বয়সী আতাউরের। নতুন করে দেওয়া শাটডাউন ও সাম্প্রতিক বিধিনিষেধের কারণে এ কাজটিও আর করার সুযোগ নেই তার। ফলে স্ত্রী ও ছেলেকে পাবনায় গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
ফাঁকা ও অন্ধকার সিনেমা হলে বসে ধরা গলায় আতাউর বলেন, ‘কোনো আয় ছাড়া আমরা কীভাবে বেঁচে আছি, তা আপনি ভাবতেও পারবেন না। মাঝে মাঝে দিনে শুধু একবার খাই। এখন টিকে থাকতে হলে রক্ত বিক্রি করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।’
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন ধারণ ক্ষমতার ১৪০টি সিনেমা হলে আনুমানিক ১৫০০ মানুষ কাজ করেন।
দর্শকরা বড় পর্দায় যেসব দৃশ্য দেখে চোখের পানি ফেলেন, সিনেমা হল কর্মীদের বেশিরভাগই বাস্তবে এমন করুণ জীবনযাপন করছেন এখন।
তাদের কেউ চিকিৎসা ছাড়াই স্ত্রীকে মারা যেতে দেখেছেন অসহায় চোখে। কেউ আবার মরিয়া হয়ে কিডনি বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। আরও অনেক ঘটনা আছে এমন।
ব্যবসায় ধস নামা সিনেমা হল মালিকরা দর্শকদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন। আর সিনেমা হল কর্মীরা উপায় খুঁজছেন খেয়ে পরে বেঁচে থাকার। এ কর্মীরা সারাবছর হলে চলচ্চিত্র চালানোর জন্য শ্রম দিলেও, এ নিষ্ঠুর সময়ে তারা শুধু অবহেলাই পেয়েছেন।
গত বছরের মার্চ থেকে সাত মাসের জন্য বন্ধ থাকার পর সিনেমা হলগুলো শর্তসাপেক্ষে খুলে দেওয়া হয়। ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে এগুলো আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উত্থানের কারণে চলচ্চিত্রের সংখ্যা ও সিনেমা হলে দর্শকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় হল মালিকরা অনেকদিন ধরেই দুর্দশায় ছিলেন। এ অবস্থায় করোনা মহামারি চলচ্চিত্র শিল্পের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
ইন্ডাস্ট্রির লোকজন বলছেন, গত বছরের বিধিনিষেধের সময় সরকার সিনেমা হল কর্মীদের প্রত্যেককে আড়াই হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দিয়েছিল। তবে, এবার এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
আতাউরের ভাষায়, ‘আমাদের দেখার মতো কেউ নেই। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও খোঁজ নেন না।’
১৯৯০ সালে মাসিক ১০ টাকা বেতনে আতাউর সিনেমা হলে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। প্রায় ২৫টি সিনেমা হলে কাজ করার মাধ্যমে দক্ষ প্রজেক্টর অপারেটর হয়ে ওঠেন তিনি। এসব সিনেমা হলের বেশিরভাগই দেশের উত্তরাঞ্চলের।
আবার কবে সিনেমা হল ব্যস্ত হয়ে উঠবে জানেন না তিনি।
‘এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমিও টিকব না, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও টিকবে না’, বলেন আতাউর।
আরেক সিনেমা হল কর্মী রুবেল মিয়াও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। আয় না থাকায় ইতোমধ্যে পারিবারিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
৩৫ বছর বয়সী রুবেল ফার্মগেটের ছন্দ সিনেমা হলে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। গত দেড় বছর ধরে বেতন পান না তিনি। অর্থ সংকটে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পারেননি। গত ২৩ জুন মারা যান তার স্ত্রী।
অশ্রুসিক্ত চোখে রুবেল বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য কিছুই করতে পারিনি। সে আমার চোখের সামনেই মারা গেল। আমার ছোট ছেলের বয়স মাত্র তিন মাস।’
নবজাতকসহ রুবেলের তিন সন্তান এখন নোয়াখালীতে তার মায়ের কাছে। জীবিকার প্রয়োজনে তিনি ঢাকাতেই আছেন। সিনেমা হল বন্ধ থাকায় তাকে কখনো রিকশা চালাতে হয়েছে, কখনো দিনমজুরের কাজ পর্যন্ত করতে হয়েছে।
‘বিশ্বাস করেন, ছোট বাচ্চাটার জন্য দুধ কেনার টাকাটাও নেই আমার। আমার মা প্রায়ই কল দেন, কিন্তু আমি ধরি না। ধরে কী বলব তাকে?’
কয়েক মাসের বাসা ভাড়াও বাকি আছে রুবেলের। এজন্য বাসায়ও যান না তিনি।
তার আশা ছিল শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক ও সিনেমা হল মালিকরা হল কর্মীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু, বাস্তবে এটি ঘটেনি।
তার মতো সব কর্মীদের একই অভিযোগ।
আনন্দ সিনেমা হলের আরেক প্রজেক্টর অপারেটর মো. ওয়াসিম খান কাজ করছেন গত ১৫ বছর ধরে। সিনেমা হলের ম্যানেজার ও জেনারেল ম্যানেজারের কাছে বেতন চাইতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, হল বন্ধ থাকায় তাকে আর বেতন দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন তারা।
তিনি বলেন, ‘আমার মতো আমার স্ত্রী আর ছেলেও বেশিরভাগ সময় না খেয়ে পার করছে।’
ওয়াসিম আরও বলেন, ‘সরকার সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে নগদ প্রণোদনা দিলেও সিনেমা হল কর্মীরা বাদ পড়েছে।’
‘এমনকি শিল্পী ও প্রযোজকরাও আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেননি।’
‘আমরা ত্রাণ চাই না। সিনেমা হলগুলো যদি খোলা রাখা হয়, তবে আমরা নিজেদের টাকা দিয়েই চলতে পারি’, ওয়াসিম যোগ করেন।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জলের মতে, সিনেমা হল ইন্ডাস্ট্রি এখন ‘আইসিইউতে আছে’।
‘সিনেমা হলগুলোতে চালানোর মতো কোনো ভালো সিনেমা গত দুই বছরে পাইনি আমরা। শো চালাতে না পারলে আমরা কীভাবে বাঁচব?’, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
অনেক সিনেমা হল সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে এবং বাকিগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে বলে জানান উজ্জ্বল।
সিনেমা হল কর্মীরা কঠিন সময় পার করছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘হল খোলা থাকলে আর শো চললে আমরা তাদের বেতন দিতে পারি। কিন্তু, কোনো আয় ছাড়া তাদের কতদিন বেতন দিতে পারব আমরা?’
তিনি আরও জানান, গত বছর বিধিনিষেধ চলাকালে সরকার প্রত্যেক কর্মীকে আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছিল। যদিও সবাই তা পায়নি। তবে, এবার সেই উদ্যোগও নেই।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান জানান, হল কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন যোগাযোগ করলে তার সংগঠন তাদের সহায়তা দেবে।
তিনি বলেন, ‘তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে। তবে, আমাদের সংগঠনেরও সীমাবদ্ধতা আছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি যদি সহায়তা চায়, তবে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারলে খুশি হব।’
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম
Comments