আকাশ যার সীমানা
কে কার চেয়ে উঁচু ভবন তৈরি করবেন, এ নিয়ে দেশে দেশে চলে প্রতিযোগিতা। ১৯৬৫ সালে উঁচু ভবন তৈরির তত্ত্ব দিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশেরই একজন প্রকৌশলী এফ আর খান। ওই তত্ত্ব দিয়ে ১৪০ তলা পর্যন্ত ভবন তৈরি করা যায়। এবার বাংলাদেশের আরেক প্রকৌশলী ফিরোজ আলম এমন তত্ত্ব দিয়েছেন, যাতে ২৬৪ তলা পর্যন্ত ভবন তৈরি করা যাবে।
এক কিলোমিটার উঁচু ভবন নির্মাণে প্রায় আকাশ ছোঁয়ার এই মন্ত্র নিয়ে ইতোমধ্যেই 'প্যারালাল শেয়ার ওয়ালস-এন ইনোভোটেভ কনসেপ্ট অন মেগাটল বিল্ডিংস' নামে একটি বইও লিখে ফেলেছেন ফিরোজ আলম। জার্মানের প্রকাশনা সংস্থা 'স্কলারস প্রেস' ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, ডাচ, পোলিশ, পর্তুগিজ ও রাশিয়ানসহ মোট নয়টি ভাষায় বইটি প্রকাশ করেছে।
বইটি আমাজন এবং বিভিন্ন ইউরোপিয়ান ওয়েবসাইটে ৯৫ মার্কিন ডলারে পাওয়া যাচ্ছে।
ইতোমধ্যেই বইটি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সর্বকালের সেরা ১০০টি বইয়ের মধ্যে ২৬তম স্থান পেয়েছে।
এ ছাড়া স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে গোটা পৃথিবীতে বিক্রি হওয়া ১০০ সেরা বইয়ের মধ্যে বইটির অবস্থান ৬০ তম।
দীর্ঘ দুই দশক প্রকৌশলী হিসেবে প্রবাসে কাটিয়ে বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন ফিরোজ আলম। আলাপকালে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে পৃথিবীর সর্ব্বোচ্চ ভবন বুরুজ আল খলিফা। এর উচ্চতা দুই হাজার ৭১৯ ফুট। এর মধ্যে দুই হাজার ৬০ ফুট পর্যন্ত মানুষ বসবাসযোগ্য। বাকি ৬৫৯ ফুটকে ভ্যানিটি হাইট বা সৌন্দর্য বর্ধনকারী অংশ বলে। এই ভ্যানিটি হাইট বাদ দিলে এটি হবে ইউরোপের ১১তম উঁচু ভবনের সমান।'
ফিরোজ আলম আরও বলেন, 'আমার যে তত্ত্ব, তাতে আমি দেখিয়েছি তিন হাজার ২৮২ ফুট উঁচু ভবন তৈরি করা সম্ভব। এতে কোনো ভ্যানিটি হাইটও রাখা হয়নি। বর্তমানে ২০ তলার উপরে ভবন বানাতে গেলে বাতাস ও ভূমিকম্পের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভবন বানাতে হয়। এর জন্য কিছু অতিরিক্ত গাঠনিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। যার জন্য প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। কিন্তু আমার তত্ত্বে এসবের প্রয়োজন নেই।'
প্রকৌশলীরা বলছেন, বিশ্বে বহুতল ভবনের উদ্ভাবক ফজলুর রহমান খান, যাকে আইনস্টাইন অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বা ফাদার অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বলা হয়। পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ ভবন শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ারের নকশাও তিনি করেছেন। ১৯৬৫ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের বিখ্যাত কনসালটিং ফার্ম এসওএমে কর্মরত থাকা অবস্থায় বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য যে কাঠামোগত পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তাকে বলা হয় 'টিউব ইন টিউব'। এই ধারনার ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান বিশ্বের বহুতল উঁচু ভবনগুলো তৈরি হচ্ছে।
প্রকৌশলী ফিরোজের উদ্ভাবিত নতুন কাঠামো পদ্ধতির কৌশলটি হচ্ছে, কলামের পরিবর্তে 'প্যারালাল শেয়ার ওয়ালস কনসেপ্ট'।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ২০ বছরেরও বেশি সময় স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন ফিরোজ আলম। আমেরিকান জার্নাল অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ২০১৬ সালের ৪ জুন ফিরোজ আলমের 'ইনোভেটিভ অ্যাপ্লিকশেন অব ডিসপারসার্ড শেয়ার ওয়াল টু এ কিলোমিটার হাই কনক্রিট স্কাইসক্র্যাপার' তত্ত্বটি প্রকাশিত হয়।
এফ আর খানেরই আরেক সহযোগী বাংলাদেশি মীর এম আলী। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অন টল বিল্ডিংস অ্যান্ড আরবান হ্যাবিটেট (সিটিবিইউএইচ) এর ফেলো অধ্যাপক, শিকাগোর ইউনিভার্সিটি অব ইলিয়নস অ্যাট আরবানা ক্যাম্পেইনের স্থাপত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ফিরোজ আলমের এই তত্ত্বটির সুপারভাইজার ছিলেন।
নতুন ধারার এই নির্মাণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার জন্য ফিরোজ আলমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বনন্দিত বাংলাদেশি স্থপতি এফ আর খান এখানেই গবেষণা করতেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষকদের সামনে ফিরোজ আলম তার তত্ত্বটি উপস্থাপন করেন। অধ্যাপক মীর আলী সেখানে প্রকৌশলী ফিরোজ আলমের আবিষ্কৃত নতুন স্ট্রাকচারাল পদ্ধতিকে পৃথিবীর নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব বলে অভিহিত করেন।
এরপরই জার্মানির প্রকাশনী সংস্থা 'স্কলার্স প্রেস' থেকে ফিরোজ আলমকে এই তত্ত্বের ওপর বই লেখার অনুরোধ জানানো হয়। সেই অনুরোধে ২০১৬ সালে তিনি বইটি রচনা করেন। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী চাহিদার প্রেক্ষিতে ইংরেজির পাশাপাশি আরও আটটি ভাষায় বইটি অনুবাদ করা হয়। প্রকাশনী সংস্থার অনুরোধে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফিরোজ আলম বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন।
ফিরোজ আলমের জন্ম ১৯৬৪ সালের ২৯ জুন, রংপুরে। তার বাবা ও দাদা ছিলেন চিকিৎসক। পাঁচ ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে দুই ভাই চিকিৎসক। সবাই চেয়েছিলেন ফিরোজ আলমও চিকিৎসক হন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল তার। ঢাকার মোহাম্মদপুরের দি বেঙ্গলি মিডিয়াম হাইস্কুল থেকে ১৯৮১ সালে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে তিতুমির কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইবি) থেকে ১৯৯১ সালে পূর্ত প্রকৌশলে স্নাতক করেন।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। ১৯৯৭ সালে ডিজাইন প্রকৌশলী হিসেবে চলে যান সৌদি আরবে। ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। এরপর দুবাই যান। সেখান থেকে কাতার সরকার তাকে উঁচু ভবনের নকশা তৈরির জন্য আমন্ত্রণ জানান। ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত কাতারে জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করে দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পাবলিক ওয়ার্কস অথরিটিতে ডিজাইন প্রকৌশলী হিসেবে উচ্চ বেতনে নিয়োগ পান।
ফিরোজ আলম ডেইলি স্টারকে জানান, পাবলিক ওয়ার্কস অথরিটিতে যোগ দেওয়ার পর তার কাজের চাপ কমে যায়। তখন বসে বসে নকশা করতেন।
তিনি বলেন, 'কাতার সরকার আমাকে ছয় থেকে ১০ তলা ভবনের নকশার করতে দিত। মাথায় তখন উঁচু ভবন করার চিন্তা। তখন তাদের বলেছি, ৮০ থেকে ১০০ তলা ভবনের নকশা করতে দাও। তখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দোহায় কংক্রিট শেয়ারওয়াল দিয়ে হাইরাইজ ভবনের নকশা করতে দেয়। সেটি ছিল ৫৪ তলা আবাসিক টাওয়ার। ভূমি থেকে ৬৩০ ফুট লম্বা।'
'৫৪ তলা এই ভবনের মূল নকশা পুনর্বিবেচনার সময় আমি তাতে স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে ত্রুটি পাই। তখন তারা আমাকে পুনরায় নকশা করার অনুরোধ করলে আমি এর সঠিক ডিজাইন করে দেই। এরপর সারাদিন নকশা করতাম, কী করে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু, দুবাইয়ের ১৬৭ তলা থেকেও উঁচু ভবন করা যায়। ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে কাজ শুরু করলাম। এরপর প্যারালাল শেয়ার ওয়ালের ধারনা প্রতিষ্ঠা করলাম। আমি এখন বলতে পারি, ২৬৪ তলা ভবন তৈরি সম্ভব,' যোগ করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, সাধারণত ২০ তলার ওপরের ভবনকে হাইরাইজ বা টল বিল্ডিং বলা হয়। বর্তমানে এমন মেগা টল বিল্ডিং নির্মাণে বাতাস আর ভূমিকম্পের প্রভাবকে প্রাধান্য দিয়ে ভবনকে মজবুত করার জন্য ব্রেসিংস, আউট্রিগারস, বেল্ট ট্রাস ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু ফিরোজ আলমের প্যারালাল শেয়ার ওয়ালস তত্ত্বে এসবের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া তিনি পূর্ববর্তী কাঠামোগত পদ্ধতির অনেক অসুবিধাও দূর করেছেন। ফলে উঁচু ভবন নির্মাণের খরচও কমে যাবে।
প্রকৌশলীদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) কাতারের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান উপদেষ্টা কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে ইমেইলে বলেন, 'আমি নিজেও একজন পূর্ত প্রকৌশলী। এক কিলোমিটারের উঁচু ভবন তৈরি করা এতদিন শুধু কল্পনাতেই ছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন জন কাজ করেছেন। তিন হাজার ২৮২ ফুট উঁচু ভবন তৈরির সেই স্বপ্নের উদ্ভাবক একজন বাংলাদেশি, এটা আমাদের জন্য গর্বের। আর কাতারে থাকতে অনেকবার ফিরোজ আলমের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি এখন কাতার ছেড়ে বাংলাদেশে গেছেন। আমার মনে হয় তাকে বাংলাদেশের কাজে লাগানো উচিত।'
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলীদের সংগঠন আইইবির সাবেক সভাপতি ও ঢাকা ওয়াসার বর্তমান চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশের আর কোনো প্রকৌশলীর তত্ত্ব বা বই সারা পৃথিবীতে এতটা সাড়া ফেলেনি। ফিরোজ আলমের বইটি সর্বকালের সেরা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বইয়ের তালিকায় শুধু আছে তাই নয়, দেশে দেশে এটি প্রকৌশলীরা পড়ছেন। বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন। তবে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ফিরোজ আলমকে যেভাবে সম্মান দেওয়ার দরকার ছিল আমরা সেটি দিতে পারিনি। এটি আমাদের জাতীয় দৈন্যতা।'
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিউল বারী বলেন, 'ফিরোজ আলম যে তত্ত্বটি দিয়েছেন, তাতে নতুনত্ত্ব আছে। তবে এর প্রয়োগটাই আসল চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে কেউ শত শত তলা উঁচু ভবন করতে চাইবে না। অন্য কোথাও যদি এর প্রয়োগ করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে বিষয়টি কেমন। দেখা যাক কোন দেশ সেই কাজটি করে। তবে ৩০ থেকে ৪০ তলা ভবন তৈরি করতে গিয়েও যদি এই প্যারালাল শেয়ার ওয়ালস তত্ত্ব কাজে লাগানো যায়, তাতেও উপকার হবে।'
রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম বলেন, 'পূর্বাচলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ৫২, ৭১ ও ১৪০ তলা তিনটি ভবন নিয়ে একটি আইকনিক টাওয়ার তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিকাগো শহরের বিখ্যাত কনসালটিং ফার্ম এসওএম এর ডিজাইন করবে। ফিরোজ আলমকে আমরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে বলেছি। যেহেতু তিনি বাংলাদেশের সন্তান এবং বহুতল ভবনের জন্য দারুণ একটি ভাবনা দিয়েছেন, আমরা এর প্রায়োগিক বিষয়গুলো দেখতে চাই।'
ফিরোজ আলম বলেন, 'মূলত যারা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে গবেষণা করেন, তারা এই বইয়ের পাঠক। বইটি প্রকাশের পর বিশ্বের বহু দেশে এই তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছে। এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যে কাতারে ও ভারতে বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশেও এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ৩০ তলা থেকে শুরু করে আরও উঁচু বহুতল ভবন নির্মাণ করা যেতে পারে। এতে করে জমি ও খরচ দুটোই সাশ্রয় হবে। আমি মনে করি এতে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দুনিয়া উপকৃত হবে।'
Comments