হলি আর্টিজান হামলার ৬ বছর: অনলাইনে কিছু জঙ্গি সংগঠন এখনও সক্রিয়
গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে ২০১৬ সালে হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন নব্য-জেএমবি। এই মুহূর্তে আরেকটি হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা তাদের না থাকলেও পুলিশ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অন্য কয়েকটি সংগঠনকে হুমকি হিসেবে দেখছেন।
তাদের মতে, জঙ্গি সংগঠনগুলো অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে।
তারা আরও জানান, ইন্টারনেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে জঙ্গি কনটেন্ট রয়েছে, যা মানুষকে এ ধরনের আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, 'নব্য-জেএমবি এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। তাদের কোনো সক্রিয় কর্মী বা নেতা নেই।'
সিটিটিসির কর্মকর্তাদের মতে, নিষিদ্ধ হওয়া সংগঠনটির প্রধান মেহেদী হাসান জন তুরস্কের একটি গোপন আস্তানা থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
তবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও হিযবুত তাহরীর এখনো সক্রিয় রয়েছে।
তারা আরও জানান, হিযবুত তাহরীর এখনও বড় উদ্বেগের বিষয়, কারণ সংগঠনের শীর্ষ নেতা মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন এখনো পলাতক।
পুলিশের মতে, এই সংগঠনটি 'স্লিপার সেলের' মাধ্যমে কাজ করে। যার অর্থ, সদস্যরা একে অপরের পরিচয় জানতে পারেন না এবং নেতারা বেনামে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
একজন সিটিটিসি কর্মকর্তা জানান, তারা এনক্রিপটেড মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং কোডের মাধ্যমে ভার্চুয়াল পরিচয় ধারণ করেন।
'একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বাকিদের চিহ্নিত করতে পারে না,' যোগ করেন তিনি।
সিটিটিসি প্রধান জানান, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। কারণ সংগঠনটির মূল সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধের সময়ে জঙ্গি কার্যক্রম কিছুটা বাড়লেও এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। দীর্ঘদিন জঙ্গিদের চিহ্নিত ও আটকের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত এক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা জানান, এই নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যরা এখন শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় চাকরি খুঁজছেন।
কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক বছরে নিষিদ্ধ সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম, বাংলাদেশ (হুজি-বি) এবং জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে।
সিটিটিসির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে হুজি-বি ১৬টি হামলায় ১৪৫ জনকে হত্যা করে। ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে জেএমবি ২৩টি হামলায় ৭০ জনকে হত্যা করে।
সিটিটিসির সাবেক প্রধান ও বর্তমানে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম কাউন্টার টেরোরিজম জার্নালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে জানান, জঙ্গিরা সাইবার স্পেস ব্যবহার করে তাদের বার্তা ছড়াচ্ছে।
এ ছাড়া, তারা অনলাইনে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা ছড়ানো, নতুন কর্মী নিয়োগ, তহবিল সংগ্রহ, নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও জঙ্গি হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এর (মৌলবাদের) উত্থান দেখা যাচ্ছে।
'কাউন্টার টেরোরিজম একটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ কাজ, যার সঙ্গে সমাজের সকল অংশকে সম্পৃক্ত হতে হবে,' যোগ করেন তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনিরুজ্জামান জানান, কিছুদিন পরপর সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার এটাই ইঙ্গিত করে যে জঙ্গিরা এখনো সক্রিয় আছে।
তিনি জানান, একটি জাতীয় জঙ্গি বিরোধী কৌশলগত নীতিমালা প্রয়োজন, যেখানে সরকার, পুলিশ ও সমাজের অন্যান্য অংশীজনদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা উল্লেখ করা থাকবে।
সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান জানান, পুলিশ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অনলাইন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি আরও জানান, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে (এবং এর খারাপ পরিণতি দেখে) জঙ্গিদের পক্ষে নতুন সদস্য পাওয়া বেশ জটিল হয়ে পড়েছে।
হলি আর্টিজান হামলা ও নব্য-জেএমবি
প্রয়াত বাংলাদেশি-কানাডীয় নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী ২০১৩ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে আসার পর নব্য-জেএমবি গঠন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংস্থা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কার্যক্রমে অনুপ্রাণিত হয়ে এই সংগঠনটি চালু করেন।
এই সংগঠনটি ঢাকার গুলশানের রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজানে হামলার পেছনে দায়ী ছিল। ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের হামলায় ১৭ জন বিদেশি নাগরিক ও ২ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জন নিহত হন।
২০১৬ সালে নব্য-জেএমবি ও আল কায়েদার অনুপ্রেরণায় গঠিত আনসার আল ইসলাম মোট ৫৩টি হামলায় ৬০ জনকে হত্যা করে। পরবর্তী বছর নব্য-জেএমবির আক্রমণে সিলেটে ৩ পুলিশসহ ৫ জন নিহত হন।
হলি আর্টিজান হামলার পর সিটিটিসি দেশব্যাপী গোয়েন্দা অভিযান শুরু করে।
র্যাব ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করে।
হলি আর্টিজান হামলার পর সিটিটিসি এ পর্যন্ত ৫১২ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা জঙ্গি আস্তানায় ২৮টি অভিযান চালায়, এ সময় ৭৯ জন জঙ্গি নিহত হন এবং প্রচুর বিস্ফোরক উপকরণ ধ্বংস ও আটক করা হয়।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments