পদ্মাসেতুর জমি অধিগ্রহণে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ, সার্ভেয়ারকে বরখাস্তের সুপারিশ

পদ্মা সেতু। ছবি: স্টার

শরীয়তপুরের পদ্মাসেতু নাওডোবা ও শরীয়তপুর চারলেন সংযোগ সড়কের ভূমি অধিগ্রহণের কাজে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সার্ভেয়ারকে বরখাস্তের সুপারিশ করা হয়েছে।

শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলএ শাখার সার্ভেয়ার মোশারফ হোসেনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান মঙ্গলবার 'বরখাস্ত ও সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালা ২০১৮' অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি দেন তিনি। চিঠিতে সার্ভেয়ার মোশারফ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্তে সুপারিশ করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান মুঠোফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সার্ভেয়ার মোশারফ হোসেন পদ্মাসেতু নাওডোবা ও শরীয়তপুর চারলেন সংযোগ সড়কের ভূমি অধিগ্রহণের সার্ভের দায়িত্ব পালন করেন। তার বিরুদ্ধে আমদের কাছে অভিযোগ ছিল মোশারফ ওই সড়কের বিভিন্ন এলএ কেসের যৌথ তদন্তে গিয়ে নতুন ঘরের মালিকদের বলেছেন নতুন ঘরের ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে না। তবে তিনি ঘরগুলো ক্ষতিপূরণের তালিকা ভূক্ত করে দেবেন এবং ক্ষতিপূরণের বেশি টাকা পাইয়ে দেবেন। যদি তাকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়। তখন নতুন ঘরের মালিকরা তালিকাভূক্তির জন্য তাকে বিভিন্ন অংকের টাকা ঘুষ দেন।

তিনি আরও বলেন, মোশারফের কারণে জেলা প্রশাসনের ভাবমূর্তি মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। মোশারফের বিরুদ্ধে এর আগেও দুদকে দুটি মামলা হয়েছিল। তার একটিতে তিনি কারাগারে ছিলেন। এমনকি সাময়িক বরখাস্তও হয়েছিলেন। ক্ষতিপূরণের কথা বলে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, মানুষকে হয়রানি করা এমন খবর পেয়ে তাকে ওএসডি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে ছিল না। এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেওয়ার কিছু ডকুমেন্ট হাতে আসার পর তাকে বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করেছি। আশা করছি খুব শিগগির বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর নাওডোবা প্রান্ত থেকে শরীয়তপুর জেলা শহর পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে গত বছর ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয় জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটির  (একনেক) সভায়। এর পর ২৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের প্রকল্প শুরু করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। শরীয়তপুর সওজ বিভাগ চারলেন সড়ক নির্মাণের জন্য ১০০ সাড়ে ৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের জন্য চিঠি দেয় জেলা প্রশাসনকে। ২৭ কিলোমিটার সড়কের জন্য জেলা প্রশাসন ২১টি এলএ কেসের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু করেছে। ৬টি এলএ কেসের যৌথতদন্তের কাজ শেষ করা হয়েছে।

ওই সড়কের অন্যান্য এলএ কেসের স্থাপনার তালিকা প্রস্তুত করছে প্রত্যাশী সংস্থা (সওজ) ও জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা।

সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে এমন খবর পেয়ে স্থানীয় একটি চক্র টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে নতুন করে ঘর নির্মাণ করতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসন ওই সব ঘরের তালিকা করে তা অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়।

ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মোশারফ হোসেন ওই সড়কের বিভিন্ন এলএ কেসের যৌথ তদন্তে গিয়ে নতুন ঘরের মালিকদের আশ্বাস দেন তিনি ঘরগুলো ক্ষতিপূরণের তালিকাভুক্ত করে দেবেন এবং ক্ষতিপূরণের বেশি টাকা পাইয়ে দেবেন। তখন নতুন ঘরের (বাদ পরা ঘর) মালিকরা তাকে বিভিন্ন অংকের টাকা ঘুষ দেন। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গত ৩০ এপ্রিল মোশারফ হোসেনকে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন থেকে গাজীপুরে বদলি করা হয়। এমন খবর পেয়ে নতুন ঘর নির্মাণ চক্রের সদস্য শিবচরের কুতুব-পুর এলাকার বাসিন্দা মো. শাকিল ১৫-২০ জন লেক নিয়ে সোমবার জেলা প্রশাসনের এলএ শাখায় আসেন।

শাকিল অভিযোগ করেন, সার্ভেয়ার মোশারফ হোসেন তার কয়েকটি ঘর ক্ষতিপূরণের তালিকায় উঠিয়ে দেবেন। এ জন্য তার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। অভিযোগের সঙ্গে শাকিল একটি চুক্তিনামা জমা দেন। তাতে মোশারফ হোসেন চুক্তি করেন আগামী ৯ জুনের মধ্য শাকিলের কাছ থেকে নেওয়া ১৫ লাখ টাকা ফেরত দেবেন। এর বিপরীতে মোশারফের স্ত্রী সালমা আক্তার বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ঢাকার মৌচাক শাখার একটি চেক দিয়েছেন শাকিলকে।

সোমবার দুপুরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আসমাউল হুসনা লিজার কাছে শাকিলের নামে দেওয়া ১৫ লাখ টাকার চেক ও অঙ্গিকারনামার স্ট্যাম্প পৌঁছায়। তিনি মোশারফ ও শাকিলকে ডেকে ঘটনাটি জানতে চান। এরপর মোশারফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকে রাখা হয়।

তখন জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে তিনি পালিয়ে যান। বিষয়টি জেলা প্রশাসকে জানালে তিনি সব ডকুমেন্ট যাচাই-বাছাই করে ঘটনার সত্যতা পান। বুধবার জেলা প্রশাসক মোশারফকে সাময়িক বরখাস্ত ও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি দিয়েছেন।

রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর শরীয়তপুর কর্তৃক সত্যায়িত সেই চুক্তিপত্র এবং চেকটি দ্য ডেইলি স্টার সংগ্রহ করেছে।

চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল ৬ মাস পূর্বে দ্বিতীয় পক্ষ মোশারফ কাজের কারণে প্রথম পক্ষ শাকিলের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন। উক্ত কাজ সঠিকভাবে সম্পূর্ণ না করলে মোশারফ শাকিলকে ২০২২ সালের ৯ জুন তারিখের মধ্যে সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দেবেন। এর বিপরীতে মোশারফের স্ত্রী সালমা আক্তার ১৫ জুন তারিখ উল্লেখ করে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ঢাকার মৌচাক শাখার একটি চেক প্রদান করেছেন শাকিলকে।

শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আসমাউল হুসনা লিজা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, মোশারফ হোসেন এর বিরুদ্ধে জমি অধিগ্রহণের কাজে গিয়ে অনিয়মের মৌখিক অভিযোগ পাই। অভিযোগ পাওয়ার পর তখন তাকে বদলি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বদলি হওয়ার খবর পেয়ে যারা তাকে টাকা দিয়েছিলেন তারা এলএ শাখায় ভিড় করেন।  বিষয়টি নজরে আসলে আমরা প্রমাণ হিসেবে কিছু ডকুমেন্ট হাতে পাই। তখন মোশারফের এসব প্রতারণার সত্যতা পাওয়া যায়। পরে গত বুধবার মোশারফকে সাময়িক বরখাস্ত ও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি প্রদান করা হয়।

সার্ভেয়ার মোশারফের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি। ক্ষুদেবার্তা দিয়ে দিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলেও তিনি কোন সাড়া দেননি।

Comments

The Daily Star  | English

Panic grips NBR officials

The relief that followed the end of a disruptive strike by tax officials at the National Board of Revenue has quickly given way to anxiety and regret, as the government started a clampdown on those involved.

13h ago