পাঞ্জাবে মোট গ্রাহকের প্রায় ৮৪ শতাংশই বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পাবেন

ভর্তুকি ও বিনামূল্যে পরিষেবা দেওয়া একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক কৌশল। বিভিন্ন দেশের সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে বলে এই কৌশল বিশ্বব্যাপী সমালোচিত।

তারপরও, কিছুটা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে উত্তর ভারতীয় রাজ্য পাঞ্জাবের নবনির্বাচিত আম আদমি পার্টি সরকার প্রতিটি ঘরে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে প্রতিটি বাড়িতে গ্রাহকরা সর্বোচ্চ ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে পাবেন। এর জন্য গ্রাহকদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।

গত মাসে পাঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য উদ্যোগের প্রতিশ্রুতির ওপর ভর করে জয়লাভ করে। তবে তাদের ট্রাম্পকার্ড ছিল প্রতি মাসে প্রতি পরিবারে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি।

গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাঞ্জাব সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, 'পাঞ্জাবে ইতোমধ্যে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার একটি উদ্যোগ চালু আছে। এই উদ্যোগের আওতায় শূদ্র, দলিত ও দারিদ্রসীমার নিচে থাকা পরিবারগুলো ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে পান। এখন তারাও ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে পাবেন। কেউ যদি ৩০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তাহলে শুধুমাত্র বাড়তি বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করবেন।'

নতুন করে যারা এই সেবার আওতায় আসবেন, তারাও ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে পাবেন।

'তবে তাদের কেউ যদি ৩০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহার করেন, তাহলে তাদেরকে সম্পূর্ণ ইউনিটের জন্যই বিল দিতে হবে,' যোগ করেন ওই কর্মকর্তা।

অর্থাৎ, ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও ৩০১ ইউনিট খরচ হলে পুরো ৩০১ ইউনিটের বিলই দিতে হবে।

পাঞ্জাবে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়ার সুবিধাটি আম আদমি পার্টির 'দিল্লি মডেল' অনুকরণে তৈরি হয়েছে। দিল্লিতে এই দলের প্রধান ও মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার প্রতিটি বাড়িতে প্রতিমাসে বিনামূল্যে ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ বিনামূল্যে দিচ্ছে। এ ছাড়াও, তিনি এই মডেলের আওতায় সরকারি স্কুলের জন্য অত্যাধুনিক ভবন তৈরি করেছেন, স্কুলের শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ করে দিতে ও তাদের ব্যবসার পরিকল্পনাগুলোয় অর্থায়ন করতে 'বিজনেস ব্লাস্টার প্রোগ্রাম' চালু করেছেন এবং কয়েকশ মহল্লা ক্লিনিক চালু করেছেন।

পাঞ্জাবে প্রায় ৭৩ লাখ আবাসিক গ্রাহক ও ১৪ লাখ কৃষিখাতের গ্রাহক রয়েছে। কৃষিখাতের গ্রাহকরা আগে থেকেই বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পান। পাশাপাশি, ১১ লাখ ৫০ হাজার বাণিজ্যিক ও দেড় লাখ শিল্প গ্রাহকও রয়েছে এই রাজ্যে।

এর আগে, আবাসিক গ্রাহকরা ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ বিনামূল্যে উপভোগ করছিলেন।

পাঞ্জাব রাজ্যের বাজেট বেশ চাপের মুখে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার নতুন করে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকির ভার বহন করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাঞ্জাবের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ইতোমধ্যে এ রাজ্যের সার্বিকভাবে ৩ লাখ কোটি রুপিরও বেশি ঋণ রয়েছে। চলতি অর্থবছরে রাজ্যের প্রাক্কলিত রাজস্ব আয় ৯৫ হাজার ২৫৭ কোটি রুপির মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই ব্যবহার করতে হবে ঋণ পরিশোধে।

২০২১-২২ অর্থবছরে পাঞ্জাব সরকার জ্বালানিখাতে ভর্তুকি বাবদ ১০ হাজার ৬৬৮ কোটি রুপি ব্যয় করে। এর মধ্যে, ৭ হাজার ১৮০ কোটি রুপি কৃষকের জন্য ও ১ হাজার ৬২৭ কোটি রুপি শূদ্র, দলিত ও দারিদ্রসীমার নিচে থাকা পরিবারগুলোর জন্য। ভর্তুকি বিলের বাকি অংশ মূলত আবাসিক ও বিভিন্ন শিল্পখাতে বিদ্যুৎ খরচের ওপর ছাড় দেওয়ার জন্য ব্যয় করা হয়েছে।

আম আদমি পার্টির বিনামূল্যে বিদ্যুৎসেবার নতুন উদ্যোগটি চালু হলে ভর্তুকি বাবদ খরচ কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি রুপি বাড়তে পারে, যা বর্তমান ব্যয় ১০ হাজার ৬৬৮ কোটির সঙ্গে যোগ হবে।

পাঞ্জাবের স্টেট পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, বিনামূল্যে বিদ্যুৎসেবা বাস্তবায়িত হলে রাজ্যের মোট ৭৩ লাখ ৮০ হাজার গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৬২ লাখ ২৫ হাজার গ্রাহক বিশেষভাবে উপকৃত হবেন। কেননা, তাদের বর্তমান মাসিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ৩০০ ইউনিট বা তারচেয়েও কম।

পাঞ্জাব স্টেট পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের এক কর্মকর্তা জানান, বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণের প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে পাঞ্জাব সরকার নির্ধারণ করেছে যে, গড়ে ৬২ লাখ ২৫ হাজার গ্রাহক বিনামূল্যে বিদ্যুৎসেবা পাবেন। অর্থাৎ, মোট গ্রাহকের প্রায় ৮৪ শতাংশই বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পাবেন।

কর্মকর্তা জানান, পাঞ্জাব সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির আবাসিক গ্রাহকের জন্য ৩ হাজার ৯৯৮ কোটি রুপি ভর্তুকি দিচ্ছে।

আগের ব্যবহারের ধারা অনুযায়ী, বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বিল আরও বাড়বে। কারণ এখন বেশিরভাগ গ্রাহক ১৫০ ইউনিট ব্যবহার করছেন। এই গ্রাহকরা বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পেলে ৩০০ ইউনিট খরচ করার চেষ্টা করবেন।

কর্মকর্তারা আগামী জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সুবিধার ২টি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করছেন। প্রথমত, অনেক পরিবার ভর্তুকির সুবিধা পেতে তাদের বিদ্যুৎ মিটার আলাদা করে ফেলবেন। এতে করে একই পরিবার একাধিক মিটারের সাহায্যে আরও বেশি ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পাবেন। দ্বিতীয়ত, অনেকে ভর্তুকির সুবিধা নিতে বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে ৩০০ ইউনিটের নিচে নিয়ে যাবেন।

এখন সবার মনে প্রশ্ন একটাই, কীভাবে পাঞ্জাব আম আদমি পার্টির জনপ্রিয়তা অর্জনের এই রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, যেখানে এই রাজ্যের মাথাপিছু আয় কমছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার ওপর তাদের কার্যক্রম অনেকাংশেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে?

২০০৩ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাব ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে শীর্ষে ছিল। তবে, সেই দিন আর নেই। ভারত সরকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঞ্জাবের মাথাপিছু বার্ষিক আয় কমে ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৮২ রুপি হয়েছে, যা জাতীয় গড় ১ লাখ ১৬ হাজার ৬৭ রুপির চেয়েও কম।

২০২২ সালের শেষ নাগাদ পাঞ্জাবের জনসংখ্যা ৩ কোটি হওয়ার কথা। রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটির চেয়েও বেশি। ফলে কার্যত, পাঞ্জাবের প্রত্যেক বাসিন্দা ১ লাখ রূপি ঋণের বোঝা নিয়ে আছেন।

তবে আশাবাদী হওয়ারও যথেষ্ট কারণ আছে। আম আদমি পার্টি এর আগেও দিল্লিতে একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে।

প্রায় ১ দশক ধরে দলটি দিল্লিতে ২ কোটি মানুষের জন্য কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে এবং ২০০ ইউনিটের চেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকের সংখ্যা খুবই কম। তবে দিল্লিতে আবহাওয়া বেশ চরমভাবাপন্ন। গরমে প্রচণ্ড গরম ও শীতে অধিক ঠাণ্ডার কারণে বাসিন্দারা এসি বা হিটার ছাড়া চলতে পারেন না বললেই চলে। ফলে তাদের জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ২০০ বা ৩০০ ইউনিটে সীমাবদ্ধ রাখা বেশ কঠিন। এ ছাড়াও, সার্বিকভাবে আবাসিক বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক গ্যাজেটের ব্যবহারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।

বিনামূল্যে বিদ্যুৎসেবা দেওয়ার উদ্যোগের মূলে আছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একদম নিচে থাকা অসহায় জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করা। এ ক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন হলো, কতদিন পর্যন্ত তাদেরকে সাহায্য করা হবে?

ভর্তুকি এমন হওয়া উচিৎ নয় যে এর সুবিধাভোগীরা এই বিনামূল্যে বা ছাড় দেওয়া মূল্যের ওপর পাকাপাকিভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বরং নজর দেওয়া উচিৎ এই দিকে, যাতে তাদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন হয় এবং উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে পারেন। সেটাই হওয়া উচিৎ মূল লক্ষ্য।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Cyber protection ordinance: Draft fails to shake off ghosts of the past

The newly approved draft Cyber Protection Ordinance retains many of the clauses of its predecessors that drew flak from across the world for stifling freedom of expression.

10h ago