আবারো সেই পুরনো চেহারায় পাকিস্তান

ইমরান খান। ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেট মাঠ থেকে রাজনীতিতে এসে ছক্কা হাঁকিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে যাওয়া ইমরান খান তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে সংকটময় সময়টা পার করছেন এখন।

বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ গত ২৮ মার্চ পার্লামেন্টে ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। ৩ দিন বিরতির পর গতকাল বৃহস্পতিবার সেই প্রস্তাবের ওপর বিতর্ক শুরু হয়। কিন্তু চরম হট্টগোলে কয়েক মিনিটের মধ্যে ওই অধিবেশন রোববার সকাল পর্যন্ত মুলতবি করতে বাধ্য হন স্পিকার।

গদি বাঁচাতে হলে ইমরান খানকে ৩৪২ আসনের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অন্তত ১৭৩ জন সদস্যের সমর্থন ধরে রাখতে হবে। কিন্তু তার বিরোধীরা এরই মধ্যে ১৭৭ জন সদস্যের সমর্থন জড়ো করে ফেলেছে।

কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইমরানের প্রতিদ্বন্দ্বীরা তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনেছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও পাকিস্তানের অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থার জন্যও তারা ইমরান খানকে দায়ী করছেন।

অনাস্থা প্রস্তাব ও ইমরানের প্রতিক্রিয়া

ইমরানকে অপসারণের উদ্যোগ এসেছে মূলত প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ– নওয়াজ (পিএমএলএন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) পক্ষ থেকে।

দল ২টির ভাষ্য, ইমরান খান ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি দূর করা ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রতিপক্ষ দলগুলোকে 'চোরের দল' হিসেবে অভিহিত করেন। 

তবে পিপিপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও সংসদীয় নেতা নাভিদ কামার বলেন, 'এই সরকারের কার্যক্রম হতাশাজনক। সবাই সেটা দেখতে পাচ্ছে। বিশেষ করে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে।'

গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি সাংবাদিকদের বলেন, '(ইমরানের জন্য) সম্মানজনক বিদায়ের একটাই উপায় আছে এবং সেটা হল পদত্যাগ করা।'

তবে বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক বক্তৃতায় ইমরান পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান।

তিনি বলেন, 'যখন আমি ২০ বছর ধরে ক্রিকেট খেলেছি। পুরো বিশ্ব ও যারা আমার সঙ্গে ক্রিকেট খেলেছেন, তারা দেখেছেন, কীভাবে আমি শেষ বল পর্যন্ত খেলে যাই। আমি আমার জীবনে কখনো পরাজয় মেনে নেইনি। কারো এরকম ভাবা উচিৎ নয় যে, আমি ঘরে বসে থাকব। আমি আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসব, ফলাফল যাই হোক না কেন।'

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ ইমরানের

২৭ মার্চ রোববার ইসলামাবাদে এক রাজনৈতিক সমাবেশে অংশ নেওয়ার সময় ইমরান এক টুকরো কাগজ বের করে সবাইকে দেখান। তিনি দাবি করেন, এই চিঠি তার সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব ও তার পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে পরিচালিত বিদেশি চক্রান্তের প্রমাণ।

বৃহস্পতিবারের বক্তৃতায় ইমরান অভিযোগ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরোধী দলের সঙ্গে যোগসাজশে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চক্রান্ত করছে।

২৭ মার্চ এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বক্তব্য রাখছেন। ছবি: সংগৃহীত

ওইদিন টেলিভিশনে প্রচারিত এই ভাষণে ইমরান খান বলেন, 'আমেরিকা, না, আমেরিকা নয়, আমি নাম প্রকাশ করতে পারব না এমন একটি দেশ আমাদের দেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর উদ্দেশ্যে একটি বার্তা পাঠিয়েছে।'

বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, ইমরান খান বক্তৃতার সময় ভুল করে আমেরিকার নাম বলে ফেলেন।

ইমরানের দাবি, তার অবলম্বন করা স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং ইউক্রেনে হামলা চালানোর পরপরই রাশিয়া সফরে যাওয়ার কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গাত্রদাহের কারণ হয়েছেন।

গত বুধবার ইমরানের রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতৃত্বাধীন সরকার জানিয়েছিল, একটি বিদেশি মিশনের কাছ থেকে পাওয়া তারবার্তায় সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত উন্মোচিত হয়েছে।

ইমরান জানান, বার্তায় একটি সতর্কবাণী ছিল। যেখানে বলা হয়েছে, 'যদি ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থেকে যায়, তাহলে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি হবে এবং আপনারা ঝামেলা পোহাবেন।'

ইমরান খান বলেন, 'আমি কখনো এই চক্রান্তকে সফল হতে দেব না। কপালে যাই থাকুক না কেন।'

মার্কিন দূতকে তলব

জিও নিউজের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী,  চিঠি দিয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের ঘটনায় ইসলামাবাদে মার্কিন মিশনের ভারপ্রাপ্ত উপপ্রধানকে তলব করেছে পাকিস্তান। চিঠিতে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত ভাষা ব্যবহারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসলামাবাদ।

যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত 'হুমকির চিঠির' বিষয়ে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বৈঠক হয়। এ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের 'হুমকির চিঠির' বিষয়ে কড়া প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ উদ্যোগ নিয়েছে ইসলামাবাদ।

যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য

বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতির মাধ্যমে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস জোর দিয়ে বলেন, 'এ অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই'। পাকিস্তানের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ও আইনের শাসনের প্রতি 'সম্মান ও সমর্থন' প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, 'ওয়াশিংটন পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।'

কেন এই 'চক্রান্ত'

এর আগেও ইমরান খান ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো ও নীতিমালা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টার অভিযোগ আনেন।

তিনি বৃহস্পতিবারের বক্তৃতায় তার সমর্থকদের মনে করিয়ে দেন, পাকিস্তান মার্কিন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন করে কিছুই পায়নি। বরং দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ড্রোন হামলা- উভয়ের সংখ্যাই বেড়েছে।

ইমরান খান ইতোমধ্যে ইউক্রেনে সেনা অভিযান পরিচালনার জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপনের মার্কিন প্রস্তাব নাকচ করেছেন। তার যুক্তি, এ ধরনের উদ্যোগে পাকিস্তানের কোনো অর্জন নেই। তবে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। আর তার এই অবস্থানের কারণেই তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের রুদ্র রোষের শিকার হয়েছেন। 

ইমরানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা কি বলছেন

ইমরানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা জানান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ষড়যন্ত্রের দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন।

সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিনা রাব্বানী খয়ার গণমাধ্যমকে জানান, এ ধরনের বার্তা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। এটিকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করার কিছু নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিরোধী দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও সংসদ সদস্য বলেন, ইমরান খান আগাম নির্বাচন আয়োজনের শর্তে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের দলের মুখপাত্র মরিয়ম আওরঙ্গজেব সংসদে বলেন, 'আমরা এখনই অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটগ্রহণের জন্য তার (ডেপুটি স্পিকার) প্রতি দাবি জানাচ্ছি।'

বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ সাংবাদিকদের জানান, ডেপুটি স্পিকার এজেন্ডা অনুসরণ করে আলোচনা করার অনুমতি না দিয়ে আবারও সংসদীয় রীতিনীতিকে অসম্মান করেছেন।

পরিশেষ

এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। বেশ কয়েকবার সামরিক বাহিনীর ক্যু ও জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলের ঘটনাগুলো দেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে।

আল-জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ইমরান খানের প্রশাসনের শক্তির অন্যতম উৎস হিসেবে সামরিক বাহিনীর সমর্থনকে বিবেচনা করা হয়। তবে বিশ্লেষকদের মতে, গোয়েন্দা বাহিনীর নতুন নেতা নির্বাচন বিষয়ে মতভেদের পর সামরিক বাহিনীর সমর্থন হারিয়েছেন ইমরান। তবে বিরোধী দলের নেতারা বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে সামরিক বাহিনীর ভূমিকাকে 'নিরপেক্ষ' বলে অভিহিত করেছেন।

পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরীর বরাত দিয়ে জানিয়েছে, আজ শুক্রবার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রাণনাশের চক্রান্তের বিষয়ে জানিয়েছে।

এক টুইটার বার্তায় ফাওয়াদ জানান, 'এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে।'

এ সপ্তাহের শুরুতে আরেক পিটিআই নেতা ফয়সাল ভাওদাও একই ধরনের দাবি করেন।

যদি রোববারের অনাস্থা ভোটে ইমরান পরাজিত হন, তবে তিনিই হবেন এর মাধ্যমে গদি হারানো প্রথম পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী। 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

5h ago