৯/১১: সংঘাতের ২ দশক, শরণার্থী প্রায় ৪ কোটি

টুইন টাওয়ারে হামলা ও আফগান শরণার্থী। ছবি: সংগৃহীত

৯/১১। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, তারিখটা বিশ্ববাসী কখনও ভুলতে পারবে না। ২০০১ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ২ হাজার ৯৯৭ জন নিহত এবং ৬ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন। হামলাটি যুক্তরাষ্ট্রে হলেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়েছিল গোটা বিশ্বে।

এই হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথিত বৈশ্বিক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আফগানিস্তান থেকে সেই যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, গত দুই দশকে সেই যুদ্ধ আর সংঘাত ছড়িয়েছে ইরাক, পাকিস্তান, ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া, সোমালিয়াসহ অন্তত ২৪টি দেশে। সন্ত্রাসবিরোধী এই যুদ্ধে প্রায় ৯ লাখ মানুষ মারা গেছেন, আর বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ৪ কোটি মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্স গত বছর কস্ট অব ওয়ার বা যুদ্ধের মূল্য শিরোনামে যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এই তথ্যই উঠে এসেছে।

এই রিপোর্ট এটাই ইঙ্গিত দেয়, ইউরোপ জুড়ে শরণার্থীদের যে স্রোত তার কারণও এই যুদ্ধ। এমনকি বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ মানুষ অনিয়মিতভাবে ইউরোপে যাচ্ছেন, সেটিও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে সম্পর্কিত বলেই আমি মনে করি। কারণ সিরিয়া বা আফগানিস্তানের শরণার্থীরা ইউরোপে যাওয়ার জন্য যখন মরিয়া হয়ে উঠেছিল, অনিয়মিত অভিবাসন আর মানবপাচারের যেসব পথ আবিষ্কৃত হয়েছে, বহু বাংলাদেশি ইউরোপের মোহে সেই পথেই পা বাড়িয়েছেন।

আজ ৯/১১ হামলার দুই দশক। সেদিনের হামলার পর যে আফগানিস্তান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করেছিল, আজ সেই আফগানিস্তানে তালেবানের পতাকা উড়ছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন শপথ নেওয়ার আগেই বৈশ্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে আমেরিকা পিছু হটতে শুরু করে।

এখন তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র এতো যে যুদ্ধে জড়াল, তার ফলাফল কী? এসব যুদ্ধে তো আমেরিকার সম্পদ কম খরচ হয়নি। আবার দেশে দেশে বোমা হামলা, সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। কখনও সেটা বালিতে, কখনও কাসাব্লাঙ্কায়, কখনও বা ইস্তাম্বুল বা লন্ডনে। একদিকে মানুষের জীবন আরেকদিকে সম্পদের খরচ।

ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাতেই বলা হচ্ছে, ৯/১১ এর পর যুক্তরাষ্ট্র যেসব যুদ্ধে জড়িয়েছে, তাতে ব্যয় হয়েছে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। বেসামরিক নাগরিক এবং মানবিক সহায়তার কাজে নিয়োজিত কর্মীসহ এসব যুদ্ধে ৯ লাখ মানুষ মারা গেছেন। এত কিছুর পরও স্থায়ী কোনো ফলাফল আসেনি। উল্টো বিশ্বজুড়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

গবেষণার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, খুব কম করে ধরে আনুমানিক এই হিসাব করা হয়েছে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রকৃত সংখ্যাটা হবে ৪ কোটি ৮০ লাখ থেকে ৫ কোটি ৯০ লাখ। যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র সীমিত আকারে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, সেগুলোর হিসাব যুক্ত করলে সংখ্যাটা হবে আরও বেশি।

৩০ পৃষ্ঠার এই গবেষণা প্রতিবেদন ইন্টারনেটে পাবেন যে কেউ। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ দেশে দেশে কীভাবে মানুষকে শরণার্থী করেছে, এই প্রতিবেদন তার একটি দলিল। এতে বলা হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এতো লোক বাস্তুচ্যুত হয়নি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো যুদ্ধে এত লোকের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। 

আসলে ৯/১১ এর হামলার মাত্র ৯ দিন পরেই যুক্তরাষ্ট্রে অ্যানথ্রাক্স হামলার ঘটনা ঘটে। এর দুদিন পর ২০ সেপ্টেম্বর তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ প্রথমবারের মতো উচ্চারণ করেন, ওয়ার অন টেরর বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। 

এই হামলার পেছনে ওসামা বিন লাদেন ও তার সন্ত্রাসী দল আল-কায়েদা যুক্ত বলে লাদেনকে নিজেদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আল-কায়েদা সেটি অস্বীকার করলে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানের তোরাবোরা পর্বতে শুরু হয় হামলা। লাদেন অবশ্য সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানে মার্কিন অভিযানে মৃত্যুর আগপর্যন্ত অন্তত ১০ বছর তিনি পালিয়ে ছিলেন। কিন্তু আফগানিস্তানে যে যুদ্ধ সেটি আর থামেনি। গত ২ দশকের সেই যুদ্ধে আফগানিস্তানের ৫৩ লাখ মানুষকে ঘর ছাড়তে হয়েছে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের নামে আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরাক। আফগানিস্তানে হামলার পর আল-কায়েদার কিছু সদস্য ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর ইরাকের কুর্দিস্তানে আনসার আল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে।

আফগানিস্তানে হামলার এক বছর পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর ইরাকে হামলার প্রস্তাব পাস করে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস। মাসখানেক পর ৮ নভেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক হামলার প্রস্তাব পাস হয়। বলা হয়, সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইরাকে প্রচুর পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র আছে।

জাতিসংঘে হামলার প্রস্তাব পাস হওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিরোধী মিছিল হয়। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ হামলা শুরু হলো ইরাকে। সেই যে যুদ্ধ আর সহিংসতা শুরু হয়েছিল, ইরাকে আজো তা থামেনি। ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর সাদ্দাম হোসেনকে আটক এবং পরে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তবে ইরাকে আর শান্তি আসেনি। বরং যুদ্ধ আর সহিংসতায় দেশটির ৯২ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

ইরাকের পর সিরিয়ার সবচেয়ে বেশি মানুষকে ঘর ছেড়ে শরণার্থী হতে হয়েছে। আসলে ইরাক-আফগানিস্তান যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের এপ্রিলে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক (আইএসআই) গঠন করা হয়। এসব নিয়ে সিরিয়ায় অস্থিরতা প্রকট ছিল।

অপরদিকে, আরব বসন্তে তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়ায় অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক কূটচাল আর সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাসার আল-আসাদের বাথ পার্টির বিরুদ্ধে ক্ষোভ, সবমিলিয়ে আজও গৃহযুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। এরমধ্যে ২০১৬ সালে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলামিক স্টেট (আইএস) সিরিয়ার পাকাপোক্তভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। সবমিলিয়ে বহু পক্ষ। 

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে রাশিয়া, ইরান সব বিষয়ে বাশার আল-আসাদ সরকারের পক্ষে থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা বিপক্ষে। কবে এই যুদ্ধ শেষ হবে কেউ জানে না। কিন্তু চলমান এই যুদ্ধে লাখ লাখ লোক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৫ লাখ। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন সিরিয়ার প্রায় অর্ধেক মানুষ, সংখ্যাটি অন্তত ৭১ লাখ।

এরমধ্যে সিরিয়ার শিশু আয়লান কুর্দির নিষ্প্রাণ শরীর তুরস্কের সৈকতে পড়ে থাকতে দেখে বিশ্ববিবেক প্রচণ্ডভাবে নড়ে উঠেছিল। তবে শুধু সিরিয়ার নয়, সন্ত্রাসবিরোধী এই যুদ্ধের কারণে পাকিস্তানে ৩৭ লাখ, ইয়েমেনে ৪৪ লাখ, সোমালিয়ায় ৪২ লাখ এবং লিবিয়ায় ১২ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। 

আসলে যুদ্ধ বা সংঘাতের মূল্য যে শুধু মানুষের জীবন দিয়েই দিতে হয়, তা নয়, নারী-শিশুসহ কোটি কোটি মানুষের জীবন বদলেও যায়। এই যে বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সমস্যা, তার একটা বড় কারণ এই সংঘাত। আবার অনিয়মিত অভিবাসনের কারণও এই সংঘাত। বিশেষ করে ইউরোপজুড়ে আজকে যে শরণার্থী সমস্যা, তার বড় কারণ সিরিয়া বা আফগানিস্তানের যুদ্ধ।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত ২১ লাখেরও বেশি মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন। এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

কোন কোন দেশে থেকে এভাবে ইউরোপে যাচ্ছে, সেই তালিকা খুঁজলেই দেখা যায়, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, তিউনিসিয়া, মিসর, ইরানের লোকজনরাই মূলত আছেন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাংলাদেশিরা কী করে এই তালিকায় যুক্ত হলেন? আসলে সিরিয়া, লিবিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে শরণার্থীদের ইউরোপে যাওয়ার যে স্রোত, তাতে কেবল যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশিরা।

২০১১ সালে গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার দখল নিয়ে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যেভাবে শত শত দল-উপদল জন্ম নিয়েছে, সেই যুদ্ধ আর অস্থিরতাই লিবিয়াকে মানবপাচারের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ফলে লিবিয়াকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আসলে ৯/১১ এর হামলার পর যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আফগানিস্তানে, সেই যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব এখনো ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশে। একদিকে হতাহতের ঘটনা চলছে, অন্যদিকে রোজ কেউ না কেউ শরণার্থী হচ্ছেন। কাজেই কবে শান্তি আসবে সেটা বলা মুশকিল। তবে এই কথা বলাই যায়, যতদিন এই পৃথিবীতে যুদ্ধ থাকবে, ঘৃণা থাকবে এভাবেই জীবন দিতে হবে মানুষকে। কাজেই পৃথিবী থেকে যুদ্ধ বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নেই শান্তির।

শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

shariful06du@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Palak admits shutting down internet deliberately on Hasina's order

His testimony was recorded by the International Crime Tribunal's investigation agency following a questioning session held yesterday

57m ago