রাজধানীতে ‘সিটিং সার্ভিসের’ নামে চলছে বাড়তি ভাড়া আদায়

বেশি ভাড়া আদায় করতে বাস কোম্পানিগুলো নিজেরাই নিয়ম বানায়
নির্ধারিত ভাড়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত ভাড়া আদায় চলছে ঢাকার ভেতরে চলাচল করা বাসগুলোতে। ছবি: আনিসুর রহমান

মতিঝিল থেকে যাত্রাবাড়ীর দূরত্ব তিন কিলোমিটার। বাসে এই দূরত্বে ভাড়া হওয়া উচিত পাঁচ টাকা। কিন্তু তথাকথিত ‘সিটিং সার্ভিস’ বাসে চড়ায় শাহনাজ খাতুনকে দিতে হয়েছে ১০টাকা।

এভাবেই সরকার নির্ধারিত ভাড়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত ভাড়া নির্ধারণ করছেন ঢাকার ভেতরে চলাচল করা বাসের মালিকরা। জিম্মি হয়ে পড়া যাত্রীরা বলছেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ভাড়া নির্ধারণ করার কোনই নিয়ম-কানুন নেই।

তবে অফিস শুরু ও শেষের সময় এই ‘সিটিং সার্ভিস’ বাসগুলোই আর সব সাধারণ বাসের মত হয়ে যায়। এসময় তারা দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্যও যাত্রী তোলে, ভাড়াও থাকে স্বাভাবিক।

কিন্তু এই সময়ের বাইরেই বাসগুলোতে শুরু হয় নিজেদের খেয়াল মত ভাড়া আদায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তারা বলছেন এ ধরনের ‘সিটিং সার্ভিস’ সম্পূর্ণ বেআইনি।

যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত বেশ কিছু বাস সার্ভিসে এই ‘সিস্টেম’ ব্যবহার করে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হলেও এটা বন্ধে কর্তৃপক্ষের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এই রুটে মেশকাত ও গাবতলি লিংক (সিটিং সার্ভিস) যাত্রীপ্রতি ২০ টাকা করে ভাড়া আদায় করে। অথচ বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটে দেওয়া তালিকা বলছে এখানে বড় বাসের ভাড়া হওয়া উচিত ১৫ টাকা।

‘সিটিং সার্ভিস’, ‘গেট লক’, ‘বিরতিহীন’, ‘সময় নিয়ন্ত্রণ’, ‘কম স্টপেজ’, ‘কাউন্টার সার্ভিস’ এসব গালভরা নামের বাসগুলোর এখন রমরমা কারবার। এর পরও চালকদের খেয়াল খুশিমতো যেখানে সেখানে এসব বাস দাঁড়াতে দেখাতে যায়।

বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে একটি দোকানের সেলসম্যান জালাল উদ্দিন বলেন, বাসে সিট খালি থাকলে রাস্তায় যেখানে ইচ্ছা সেখানেই চালকরা বাস দাঁড় করান সেটা রাস্তার মাঝখানেই হোক বা থামার কথা নয় এমন জায়গাই হোক।

“কিন্তু যখনই তারা বুঝতে পারে বাসের সংখ্যা যাত্রীর তুলনায় অপ্রতুল তখনই তারা বেশি ভাড়া আদায় করে। শুধু তাই নয় যাত্রীদের উঠতেও দিতে চায় না তারা,” যোগ করেন জালালের সহকর্মী মিজান আহমেদ।

যখন কথা হয় তখন তারা দুজনেই মেশকাত পরিবহনের বাসে ছিলেন। এ বছরের প্রথম দিন থেকে ‘সিটিং সার্ভিস’ নামে চলতে শুরু করেছে এই কোম্পানির বাসগুলো। আগে মেশকাতের বাসে যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট আসতে ভাড়া লাগতো ১২টাকা। এখন যাত্রীপ্রতি তারা ২০ টাকা করে আদায় করছে।

মেশকাতের মালিকদের একজন পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, “আমরা এই পরিবর্তন চাইনি। আমাদের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) জোর করে এটাকে সিটিং সার্ভিস বানিয়েছেন। আপনি বরং তার সাথেই কথা বলুন।”

এর এমডি মো শরিফুদ্দিন দিপু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, স্টাফদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে তিনি একে ‘সিটিং সার্ভিসে’ পরিণত করেছেন। কিন্তু তার কর্মীদের শৃঙ্খলার জন্য যাত্রীদের কেন বেশি ভাড়া দিতে হবে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। উল্টো তার অভিযোগ, যাত্রীরা প্রায়ই ভাড়া না দিয়েই বাস থেকে নেমে যান।

গুলিস্তান থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অনেক বাসে ১০ টাকা করে আদায় করা হয়। কিন্তু হিমাচল ও স্বাধীনের বাসে এই দূরত্বে ভাড়া দিতে হয় ২৫ টাকা। আর বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটে দেওয়া তালিকা বলছে এই দূরত্বের জন্য বড় বাসে ভাড়া আট টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।

মানা হচ্ছে না ভাড়ার তালিকা

ঢাকা মেট্রোর আঞ্চলিক ট্রান্সপোর্ট কমিটি বাস মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিআরটিএর ওয়েবসাইটে ভাড়ার তালিকা প্রকাশ করে। তালিকা অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটারে বাস ও মিনিবাসে ভাড়া যথাক্রমে এক টাকা ৭০ পয়সা ও এক টাকা ৬০ পয়সা। ন্যূনতম ভাড়া নির্ধারণ করা হয় সাত টাকা ও পাঁচ টাকা।

কিন্তু গুলশান থেকে মহাখালীর দূরত্ব এক কিলোমিটারের কম হলেও অফিস সময়ে অনেক বাসেই ১০ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হয়। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সামিউর রহমান নামের সামিউর নামের একজনের কাছে এই রুটের আলিফ পরিবহনের বাসে ১০ টাকা ভাড়া দাবি করা হয়। অতিরিক্ত ভাড়ার প্রতিবাদ করলেও বাস কনডাক্টর ভাড়ার ব্যাপারে অনড় থাকেন। এই ঘটনা ধস্তাধস্তি পর্যন্ত গড়ায়।

বিআরটিএ’র কাছ থেকে কনডাক্টরদের লাইসেন্স নেওয়ার কথা থাকলেও কারও কাছেই এই লাইসেন্স পাওয়া যায়নি। লাইসেন্স পাওয়ার শর্ত হিসেবে থাকে ন্যূনতম ১৮ বছর বয়স ও ভদ্র স্বভাব।

অথচ ঢাকায় গত দুই বছর থেকে বাসে কনডাক্টরের কাজ করে ১৭ বছরের মজিবর। তার লাইসেন্স নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বেশ আশ্চর্য হয়ে এই প্রতিবেদকের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরকম কনডাক্টরের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা রাখারও ধার ধারে না বেশিরভাগ বাস। অনেকেই আবার নিজেদের খেয়ালমত ভাড়া নির্ধারণ করে তালিকা বানিয়ে রাখে।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন বলেন, রুট পারমিট দেওয়া আঞ্চলিক পরিবহন কমিটিগুলোতে সরকারের প্রতিনিধিত্ব খুবই নগণ্য। এসব কিমিটির বেশিভাগ পদেই থাকেন বাস মালিক ও পরিবহন শ্রমিকরা। নিজেদের এই দুর্বলতার কারণে বিআরটিএ কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাস মালিকদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দল ঘেষা। এ কারণেই তারা কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেন না। তার মতে যাত্রীদের অধিকার রক্ষায় রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা থাকা দরকার।

ঢাকার সড়ক পরিবহন মালিকদের সংগঠনের মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, তারা অনেক পরিবহন মালিককে সংগঠন থেকে বাদ দিয়েছেন। রুট পারমিট বাতিল করারও সুপারিশ করেছেন তারা। ঢাকা (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের এই সহ সভাপতি আরও বলেন, “বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা দরকার।”

বিআরটিএ’র পরিচালক নাজমুল আহসান মজুমদারও স্বীকার করেন বাসের স্পেশাল সার্ভিসের কোন আইনগত ভিত্তি নেই। তাদের চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত এই বিষয়ে কাজ করেন বলে তিনি জানান। কিন্তু তাদের অভিযানের পরও বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ হচ্ছে না কেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। বাস মালিক ও পরিবহন শ্রমিকরা আইন মেনে চললে এটা বন্ধ হবে।”

Click here to read the English version of this news

Comments

The Daily Star  | English

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

10h ago