গোষ্ঠীপ্রীতি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশ হয়েছে কথাসাহিত্যিক মোহীত উল আলমের সাহিত্যপাঠ: তত্ত্ব ও তালাশ', বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ, কবি নজরুল: বিদ্রোহীর এই রক্ত । নতুন বই ও নিজের লেখালেখি  নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

কবিতা, সাহিত্য তত্ত্ব ছাড়াও গল্প নিয়ে কাজ করেন। জীবনের গল্প কীভাবে ধরা দেয় বাস্তবে? 

মোহীত উল আলম : বাস্তব চরিত্রগুলোই বেশিরভাগ সামান্য কাল্পনিক ছোঁয়ায় দাঁড়িয়ে যায়। একেবারে বানিয়ে আমি চরিত্র বা ঘটনা নির্মাণ করতে পারি না। বেশ খানিকটা নিজের জীবনের প্রতিফলনও থাকে বা অন্যদের জীবনের অভিজ্ঞতাও থাকে। তবে মজার ব্যাপার হলো, আমাকে যারা খুব নিকট থেকে চেনে এবং বহু কিছু জানে, তারাও দেখেছি আমার গল্প-উপন্যাসের মানুষগুলোর সঙ্গে আমার জীবনের লোকদের সম্পর্ক খুঁজে পায় না। আমার মনে হয়, ব্যক্তি জীবনের অতি চেনা-জানা ঘটনাও যখন সৃজনশীল রূপে গল্প বা উপন্যাসে প্রতিভাত হয় তখন লেখকের কুশলতার কারণেই এমন একটি আবহ সৃষ্টি হয় যে আমার জীবনের সঙ্গে পরিচিত পাঠকও মিলটা খুঁজে পায় না। 

সাহিত্যে বিভাজন বা গোষ্ঠীপ্রীতি বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চাকে কতটা বাধাগ্রস্ত করে?

মোহীত উল আলম : সাহিত্যে বিভাজন বা গোষ্ঠীপ্রীতি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে সম্পূর্ণরূপে বাধাগ্রস্ত করে। প্রযুক্তির বেসামাল ব্যবহারে এই গোষ্ঠীগত সাহিত্য বিভাজন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার ফলাফল হয়েছে বিরাটরকম বিভ্রান্তি। পাঠক বা মানুষ বুঝতে পারছে না কোথায় ভালো সাহিত্য রচিত হচ্ছে, কোথায় বা খারাপ। দলীয় রাজনীতি রাজনীতির জন্য ভালো যতোটা, সাহিত্যের মধ্যে দলীয় রাজনীতির প্রভাব ঠিক ততোখানিই খারাপ। এই দলীয় সাহিত্য চর্চা অব্যাহত শক্তি আর প্রেরণা পাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের দ্বারা সহজতর প্রকাশ আর চিত্রায়নের কারণে। আর দলীয় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ তো এটাকে আশকারা দেবেই, কারণ সাহিত্যের লাভ-ক্ষতিতে সত্যিকার অর্থে রাজনীতির কিছু যায় আসে না। 

অর্থনীতির সূত্রে বলতে হয়, খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে বাজারছাড়া করেছে। এবং হতাশার কথা এই যে গোষ্ঠীগত চিন্তা থেকে সাহিত্য হয়ত বেরও হয়ে আসতে পারে না। ঐতিহাসিকভাবেও কথাটা সত্য। ভালো সাহিত্য যাতে সৃষ্টি হয় সেজন্য যে রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে ব্যবস্থাদি প্রতিপালন করতে হয়, সেটির অভাব রয়েছে দেশে। 

সামাজিক মুক্তিতে  বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ কীভাবে ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন?

মোহীত উল আলম : বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বর্তমানে একটি দ্বি-ফলা রীতিতে কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে।  প্রতিবাদের জায়গায় তারা প্রতিপালনকে প্রাধান্য দিয়েছে। রাজনীতির প্রাধান্য তারা সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর রেখেছে। ফলে তুষ্টিসাধন, উঞ্ছবৃত্তি, পুরষ্কারের লোভে সাহিত্যের ইতরায়ন এখন অকাতরে ঘটে চলেছে। এ কায়দা করে অবস্থান নেওয়া বৃদ্ধিজীবী সমাজ 'রা'টি কাড়বে না। এবং যারা মধ্যম গোছের মেধার লেখক, যারা একটি অবস্থার ভিতরে যেয়ে বিশ্লেষণে অক্ষম তারা ওপরের বা সারফেইস পর্যায়ের বিষয় নিয়ে অসংখ্য অসংখ্য কলাম, নিবন্ধ, প্রবন্ধ লিখে লিখে পত্রিকার পাতা ভরিয়ে ফেলছে, এমনকি উপন্যাস লিখে বাজারজাত করছে। আর যারা উচ্চ-মেধাবী কিন্তু দলকানা তারা বিভিন্ন বড় বড় পদ দখলে নিয়ে বসে আছে, সে পদের জন্য তার যোগ্যতা থাক বা না থাক। সরল চোখে দেখেও মনে হয় সকল পর্যায়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল পদগুলোতে খুবই অযোগ্য লোকদের পদায়ন হয়েছে। সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলিতেও এই ইতরায়নের স্পষ্ট প্রতিবেশ দেখতে পাই। এটি জাতির জন্য দু:খ বয়ে আনবে বলে আমার আশংকা ।

পারিবারিকভাবে অনেক আলোকিত মানুষের স্মৃতি আছে। উল্লেখযোগ্য কারো প্রভাব আছে? 

মোহীত উল আলম : আমার বাবা নিজে সাহিত্যিক ছিলেন। সততার সঙ্গে অকৃত্রিম জীবন-চিন্তা ও জীবনচর্চার পদ্ধতি ছিল তার। সময়নিষ্ঠা, সময় নষ্ট না করা, তার দৃঢ়চিত্ততা, বিপদের মুখে দাঁড়ানোর সাহস, জীবনের একেবারে ছোট বিষয় থেকে বড় বিষয়ে সত্যমতো বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, তার দায়িত্ববোধ,  দীর্ঘ জীবন অবধি সুস্বাস্থ্যে প্রায় নিরোগ থাকা--এই সব আমার জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত এখনো হয়নি। স্বাধীন ও মুক্তিতে এতো ফারাক কেন?

মোহীত উল আলম : বাংলাদেশ জন্ম থেকেই একটি রাজনৈতিক রিটারিকের (অলঙ্কার) শিকার হয়ে বসে আছে। রিটারিকটা আবার দু'মুখো। একটি হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার রিটারিক, আরেকটি হচ্ছে ধর্মীয় পথে ইসলামি বাংলাদেশ গড়ার রিটারিক। এই দুটোর মধ্যে দ্বিতীয় রিটারিকটা পরাজিত পক্ষের কেন না আধুনিক বিশ্বে ধর্মের পথে রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা বাতুল। ফলে বাংলাদেশে এই মতবাদের রিটারিকের চূড়ান্ত অবসান হয়েছে বলা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে ততো সহজ নয়। দ্বিতীয় রিটারিকের সমর্থকেরা হয়ত ভোটে জিতবে না, কিন্তু প্রবল ধর্মীয়বোধে আচ্ছন্ন সমাজে তাদের প্রতি একটি তলায় তলায় সমর্থন রয়েই যাচ্ছে।

এটিকে কাউন্টার করার জন্য প্রথম পক্ষের রিটারিকের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনায় এই ভিন্ন মতাবলম্বীদেরকে গ্রহণ করার জন্য এমন এমন আপসমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে যাতে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্র মোটেও বিকশিত হতে পারছে না। কারণ প্রথম পক্ষের রিটারিক সেই দিকে মনোযোগ না দিয়ে, দ্বিতীয় পক্ষের রিটারিককে সংশোধন করার দিকে মনোযোগ না দিয়ে, যুক্তির বিকাশ  ও বিজ্ঞানের চর্চার দিকে মনোযোগ না দিয়ে, পরাজিত পক্ষের রিটারিককে নিজেদের বলে গ্রহণ করে সেদিকে দেশ সংস্কারের পথে নেমেছে। ফলে একটি কেঁচেগন্ডূষ অবস্থা তৈরি হয়েছে। যেগুলিকে পরিত্যাজ্য করে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলিকেই নানাভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসলেও বস্তুত চিন্তার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রে, কিংবা সাহিত্য বিকাশের পথে মুক্তি না এসে একধরনের কবন্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে পৃথিবীব্যাপী একটি যুদ্ধাবস্থা তৈরি হচ্ছে, এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ে খাদ্যাভাবসহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। 

Comments

The Daily Star  | English
 Impact of higher interest rates bangladesh

Rising interest rates deter new investment, expansion plans

Rising rates are creating headwinds for at least 40 listed conglomerates

11h ago