নতুন বাজেটে গরিবরাই ভিআইপি!

আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয় আগামী অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেট ঘোষণা করেছেন। একটা ব্রিফকেস হাতে করে তিনি সংসদ ভবনে ঢুকেছেন। যথাসময়ে ব্রিফ কেস খুলেছেন। ব্রিফকেস থেকে যদি মজার মজার চকলেট, লাঠি লজেন্স বের হয়ে আসতো তাহলে কেমন হত? অথবা ব্রিফকেস খুলে দেখলেন যে বাজেট বক্তৃতার কপি আনতে ভুলে গেছেন! এমনটা কি হয়? একবার কিন্তু হয়েছিল। ১৮৬৯ সালে জর্জ ওয়ান্ট হান্ট হাউস অব কমন্স-এ বাজেট বক্তৃতা শুরু করার সময় বাজেট বাক্স খুলে দেখেন বক্তৃতার কপি বাসায় রেখে এসেছেন!

নতুন বাজেটে অনেক আলোচিত বিষয় হল সবার জন্য সমান ভ্যাট; একক ভ্যাট। অর্থমন্ত্রী আগেই ঘোষণা দিয়েছেন ধনী গরিব নির্বিশেষে সবাইকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এর মানে হল, দেশের সব চেয়ে ধনী ব্যক্তিটি এবং রাস্তার রিকশা চালক, দিন মজুর, ভিক্ষুক বা ছাপোষা কেরানি কোনো পণ্য কিনতে গেলে অর্থমন্ত্রীকে সমান পরিমাণ ভ্যাট দিবেন। অর্থমন্ত্রী সবার কাছে থেকে সমান পরিমাণ ভ্যাট নিবেন। কারো প্রতি কোনো বৈষম্য করবেন না। এই নীতিটি অভূতপূর্ব; নজিরবিহীন। এটাতো সংবিধানের বিধান অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান; কে ধনী কে গরিব কোনো কিছু বাছ বিচার করা হবে না! এই তো সমাজতন্ত্র; যেখানে সবাই সমান। তবে সমালোচকরা এই একক ভ্যাটকে সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থি হিসেবে দুষছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পরনির্ভরতার চেয়ে নিজেদের দারিদ্রকে ভাগাভাগি করে নেওয়ায় বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন সমাজতন্ত্রী। তার চিন্তা চেতনা জুড়ে ছিল গরিব দুঃখী মানুষ। তাজউদ্দিন সাহেব বেশি সময় পাননি তার কাজ সম্পন্ন করতে; ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে তার পদ থেকে সরিয়েছেন। তবে এখন হয়তো আর দারিদ্রকে ভাগ করে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা এখন অনেক ধনী। তাজউদ্দীন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন; সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর নতুন অর্থবছরের বাজেট চার লক্ষ কোটি টাকার বেশি। কোথায় ৭৮৬ কোটি টাকা, আর কোথায় চার লক্ষ কোটি টাকা!

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে নজর রাখতে হবে আমাদের সবাইকে। সমহারে ভ্যাট পরিশোধ করে কিছু টাকা বাঁচলে সেগুলো ব্যাংকে রাখার আগে অংক কষতে বসতে হবে। কেননা আগামী ১ জুলাই থেকে ব্যাংকে থাকা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। এতে ব্যাংকে টাকা রাখলে সেখান থেকে বাড়তি শুল্ক দিতে হবে। ফলে, লাভ পাওয়া তো দূরের কথা, মূলধনের কিছু অংশ হারিয়ে যেতে পারে। কেউ কেউ বলতে পারেন এটা দিনে-দুপুরে ডাকাতি। তবে এই ডাকাতি এক বা দুবার নয়; এটা বছর জুড়েই চলতে পারে।

জ্ঞানীরা সব কিছুর মধ্যে ইতিবাচক দিক খুঁজে থাকেন! যদি জ্ঞান প্রয়োগ করেন তাহলে দেখবেন এই উদ্যোগের একটা ভালো দিক আছে। এই উদ্যোগ বলে দিচ্ছে আমাদের মাটির কাছে ফেরার সময় এসেছে! এক সময় গ্রামের লোকজন নগদ টাকা পয়সা ব্যাংকে রাখতেন না। একটা মাটির অথবা কাঁসার কলসি বা কোনো বাক্স ভর্তি টাকা ঘরের কোণে গর্ত করে পুঁতে রাখতেন। সিঁধেল চোরের ভয়ে দামি কিছু জিনিসপত্র যেমন কাঁসার থালা বাসন ও অনেক সময় বাক্সে ভরে মাটির গর্তে রাখা হতো। সে সময়ের লোকজন টাকা পয়সা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তখন গ্রাম-গঞ্জে ব্যাংকের শাখাও ছিল না। এক সময় যখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শাখা খোলা হল, তবুও গ্রামের মুরুব্বিরা ব্যাংকে টাকা পয়সা রাখতে সাহস পেতেন না, আস্থাহীনতা কাজ করতো তাদের ভিতর, টাকা যদি ব্যাংক ফেরত না দেয়, তাহলে তারা কি করতে পারবেন? তখন মানুষের অনেক সময় লেগেছে সেই ধারণা, আশঙ্কা দূর করে আস্থা তৈরি করতে।

ব্যাংকে আমানত জমা রাখা মানেই পর নির্ভরশীলতা। মাটির নিচে পুঁতে রাখুন আগের মতো, আগে যেমন স্বনির্ভর ছিলেন, তেমন স্বনির্ভর হবার সুযোগ এসেছে! সেটা কাজে লাগান!

তবে সাবধান, বেশি মাটির নিচে পুঁতে রাখাও ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা মাটির নিচের সম্পদের মালিক রাষ্ট্র—মানে সরকার। তাই মাটির নিচে পুঁতে রাখলে অর্থমন্ত্রী ওই সব টাকা পয়সাও নিয়ে নিতে পারেন। কেননা সংবিধানের ১৪৩ (১)(ক) বলছে, বাংলাদেশের যেকোন ভূমির অন্তস্থ সকল খনিজ ও অন্যান্য মূল্যসম্পন্ন সামগ্রী প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি।

তাই বলি, টাকা রাখতে বড় বড় মাটির ব্যাংক কিনুন। অথবা, চোর-ডাকাতের হাত থেকে আপনার টাকা আরও নিরাপদে রাখার জন্যে সিন্দুক বানান। ফেসবুকে একজন সুহৃদ পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, তোষকের নীচে, আলমারির চিপায়, ঘরের সিলিং, কৌটা বা চালের ডিব্বায় টাকা রাখুন। নিশ্চিন্ত না হতে পারলে টাকা দিয়ে বিছানা-বালিশ বানানোর কথা যোগ করেছেন আরেক বন্ধু।

তবে যে যাই বলুন, সামনে নতুন দিনের হাতছানি আছে। সেই হাতছানিকে কাজে লাগানোর মতো যার দৃষ্টিশক্তি আছে তিনিই সফল হবেন। তাই দৃষ্টি প্রখর করুন, চোখে ছানি থাকলে আজকেই অপারেশন করুন! নতুন দিনের নতুন বাজেট অনুযায়ী নিজের বাজেট প্রণয়ন করুন।

সব কিছুর যে দাম বেড়ে যাবে তা কিন্তু নয়। অনেক কিছুর দাম কমে যাবে। যেমন ধরুন, আপনার কাছে থাকা টাকার মান কমে যাবে, বাজারের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে আপনার মাসিক আয় কমে যাবে। সংসারে আপনার মূল্য কমে যাবে। তবে নাগরিক হিসাবে আপনার দাম অনেক বেড়ে যাবে, কারণ আপনি ভ্যাট দিবেন ধনীর সমান, আপনার ব্যাংক আমানত থেকে সরকার আবগারি শুল্ক কাটবে। রাজস্ব সংগ্রহে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর ক্রমেই নির্ভরশীল হচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।

দেখুন, নতুন দিনের নতুন বাজেট পাবলিককে কেমন ভিআইপি করেছে!

Comments

The Daily Star  | English

Manu Mia, who dug thousands of graves without pay, passes away

He had been digging graves for 50 years and never accepted any payment for his service

28m ago