ঢাবির উপাচার্য নিয়োগে আইন না মানলেও চলে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শনিবার বিক্ষোভরত ছাত্রদের কয়েকটি প্ল্যাকার্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা—ধারা ২০(১) কার্যকর কর। অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশের ধারা ২০(১) অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য সিনেট গঠন করতে হবে। সিনেটের ১০৫ জন সদস্য ভোটার, তাঁরা পরবর্তী উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করবেন।

ছাত্ররা কেন ধারা ২০(১) কার্যকর করার দাবী জানাচ্ছেন? তবে কি এ ধারা উপেক্ষা করে পরবর্তী উপাচার্য জন্য প্যানেল নির্বাচন করা হচ্ছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি তবে আইন মানে না? শিক্ষকরাও কি আইন অমান্য করছেন?

ধারা  ২০(১) অনুযায়ী সিনেটে ছাত্রদের পাঁচ জন প্রতিনিধি থাকার কথা। কিন্তু এখন তা নেই। সেটা অবশ্য প্রায় তিন দশক যাবৎ নেই। কারণ ১৯৯০ সালের পর থেকে ডাকসু নির্বাচন হয় না। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচনে গত প্রায় তিন দশক ছাত্রদের কোন ভূমিকা নেই। আইন উপেক্ষাই এতো দিনে যেন নতুন আইনে পরিণত হয়েছে! 

যে সিনেট  শনিবার পরবর্তী উপাচার্যের জন্য প্যানেল নির্বাচন করেছে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের ২৫ জন প্রতিনিধিও নেই। এ ক্ষেত্রেও ধারা  ২০(১)  উপেক্ষিত। আইন কানুন উপেক্ষা করে সিনেট বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করেছে। বর্তমান উপাচার্য আবারও চার বছরের জন্য নিয়োগ পেয়ে হ্যাট্রিক করতে যাচ্ছেন!

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ আগস্টেও একইভাবে সিনেটে নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন বর্তমান উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক। ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি সাময়িকভাবে নিয়োগ পান। এর সাড়ে চার বছর পর বিশেষ সিনেট অধিবেশন ডেকে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করেছিল।

আরও পড়ুন: দুঃখিত স্যার আরেফিন সিদ্দিক, খবরটা ভুয়া মনে হয়েছিল

ধারা ২০(১) কার্যকর করার দাবিতে শনিবার বিক্ষোভ চলাকালে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের হাতাহাতি হয়েছে। হাতাহাতির জন্য শিক্ষার্থীদের দায়ী করেছেন শিক্ষকরা। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা দোষ দিয়েছেন শিক্ষকদের। কে দায়ী, কে দায়ী নয়, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল একটা নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে। যে ঘটনা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করে দিয়েছে। এটা কার জন্য শুভ? ছাত্র না থাকলে শিক্ষকদের অস্তিত্ব থাকবে? আবার শিক্ষক না থাকলে ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করবে কার কাছে?

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাত্ররা আইন উপেক্ষা করার যে শিক্ষা পাচ্ছেন সেটা খুব ভয়ঙ্কর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি আইন উপেক্ষা করে বছরের পর বছর নতুন উপাচার্য নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন তাহলে ছাত্ররা কী শিক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ছেন? শিক্ষকরা ছাত্রদের ন্যায়ের পথে থাকতে সেখান, ন্যায়ের জন্য লড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। সারা জীবন আইন মেনে চলতে অনুপ্রাণিত করেন। আইন অমান্য করার কথা তারা কখনো ছাত্রদের বলেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি নিজেই আইন না মানে, তাহলে ছাত্ররা কী বার্তা পাবেন?

আবার ছাত্ররা তাদের আইনসংগত অধিকারের জন্য বিক্ষোভ করলে শিক্ষকরা তা দমন করতে আসবেন, দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হবে—এসবের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে?

ছাত্ররা তবে কি সব কিছু মেনে নেবে? তারা মনে করবে দাবি যত যৌক্তিক এবং ন্যায্য হোক না কেন; অধিকার যতই আইনসংগত হোক না কেন সেসবের বাস্তবায়ন নির্ভর করছে কর্তাব্যক্তিদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর। ইচ্ছা হলে তারা সহানুভূতি দেখাবেন; দয়া করে তাদের যৌক্তিক, ন্যায্য এবং আইনসংগত অধিকারের যৎকিঞ্চিত বাস্তবায়ন করবেন। তাতেই অধিকার বাস্তবায়ন প্রত্যাশীদের ধন্য হতে হবে; কর্তাব্যক্তিদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা অবনত করতে হবে। কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না।

দাবি যত যৌক্তিক এবং ন্যায্য হোক না কেন; অধিকার যতই আইনসংগত হোক না কেন—সেসবের বাস্তবায়ন চেয়ে বা বাস্তবায়ন না হলে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামার মতো হঠকারী কোনো কিছু করার বিষয় স্বপ্নেও দেখা যাবে না, কল্পনায়ও ভাবা যাবে না। কর্তাব্যক্তিরা যেমন খুশি, তেমন করবেন। সে সব নিয়ে ছাত্রদের মাথা ঘামানো তো দূরের কথা, ভাবার অধিকারও নেই।

ছাত্ররা যদি তেমনটাই ভাবতেন তাহলে আমাদের দেশের ইতিহাস অন্য রকম হতো। ভাষা আন্দোলন হতো কি? পাকিস্তান আমলে সব চেয়ে বেশি খুশি হতেন সামরিক শাসক আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানরা। তারা ছাত্রদের মাথায় তুলে রাখতেন। আবার স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরশাসকরা যারপর নাই খুশি হতেন। তারাও ছাত্রদেরকে সোনার ছেলে বলে বুকে টেনে নিতেন। কিন্তু কোনো সামরিক, স্বৈরশাসক ছাত্রদের বুকে জড়াতে পারেনি। কারণ ছাত্রদের বুকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে আগুন সেই আগুন জ্বলে উঠার ভয়ে তারা ছিলেন ভীত সন্ত্রস্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শনিবার ঘটে যাওয়া ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। একজন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর একটি মন্তব্য তুলে ধরেছেন: “একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে রকম রাষ্ট্রটিও সেরকম।”

Comments

The Daily Star  | English

BNP's name being misused for personal gains: Rizvi

He urges party men to remain vigilant against committing misdeeds

2h ago