‘ইতিহাসের দুর্ঘটনা’ থেকে মুক্ত দেশ!

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত সংসদের কাছে থাকলো না।

২০১৪ সালে সংবিধান সংশোধন করে সংসদের কাছে যে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বছর না পার হতেই হাইকোর্ট সে ক্ষমতাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আজ তা খারিজ করে দিয়ে হাই কোর্টের রায় বহাল রাখলেন।

এ রায়ের পর এখন একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। বিচারপতিদের অপসারণের কোনো পদ্ধতি এখন অনুপস্থিত। এমন সাংবিধানিক শূন্যতা দীর্ঘ দিন বহাল রাখা উচিত নয়। দ্রুত একটা ফায়সালা হওয়া দরকার। ২০১৪ সালে বাতিল করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তন করতে হলেও আবার সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। এ রায়ে সরকার খুশি হবে না সেটা নতুন করে বলার দরকার নেই। তবে দেখার বিষয় হল সরকার কীভাবে এবং কত দ্রুত এই রায় বাস্তবায়ন করে।

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা হারানোর পর সংসদের কি মানহানি ঘটলো? তার অনেক ক্ষমতায় কিছু ঘাটতি দেখা দিল?

সংসদের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা এখন অনেকটা প্রতীকী। যে সব দেশের সংসদের এ ক্ষমতা আছে তারা এ ক্ষমতা প্রয়োগের চেয়ে বরং ক্ষমতা যাতে প্রয়োগ করতে না হয় সে দিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। যে কারণে তাদেরকে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয় না।

উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই বলতে হয় যুক্তরাজ্যর কথা। দেশটিতে একসময় বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতা ছিল শুধু রাজার। সে দেশের পার্লামেন্টের সাথে রাজার দ্বন্দ্বের ইতিহাস কারো অজানা নয়। এমপিদের গ্রেফতার করতে রাজার সেনাবাহিনী পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশ করারও নজির রয়েছে সেখানে। এমপিদের বাক স্বাধীনতা এবং সংসদের মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে কয়েক জন স্পিকারকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আবার সংসদ একজন রাজাকেও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

আরও পড়ুন: 'সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ'

সেই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে একসময় পার্লামেন্ট জয়লাভ করে। অন্য অনেক ক্ষমতার মতো বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতাও তারা রাজার কাছ থেকে নিয়ে নেয়। এ জন্য বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের নিজের কাছে নেওয়ার ঘটনাকে ‘ইতিহাসের দুর্ঘটনা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়।

‘ওয়েস্টমিনিস্টার মডেল অব ডেমোক্রেসি’র অনুসারী হিসাবে আমদের সংসদকেও প্রথমে ১৯৭২ সালে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। পরে সেটা কেড়ে নেয়া হয় ১৯৭৫ সালে। আবার তা ফেরত দেয়া হয় ২০১৪ সালে। এখন আবার অই ক্ষমতা বাতিল হওয়ায় বলা যায় ‘ইতিহাসের দুর্ঘটনা’ থেকে মুক্ত দেশ!

বিচারপতি অপসারণে সংসদের ক্ষমতার কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। গত তিনশ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের। কিন্তু ১৭০১ সালে ‘এক্ট অব সেটেলমেন্ট’ এর মাধ্যমে পার্লামেন্ট ওই ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে একবারের জন্যও ওই ক্ষমতা প্রয়োগ হয়েছে বলে রেকর্ড নেই।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কে কখনো এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়নি কারণ বিচারপতি নিয়োগের সময় এত বেশি যাচাই বাছাই করা হয় যে, একবার কাউকে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর তাকে অপসারণ করতে হবে তেমন পরিস্থিতিরই উদ্ভব হয়নি।

গত সাত দশক সময় ধরে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সংসদের কাছে থাকলেও কখনো এ ক্ষমতা প্রয়োগের প্রয়োজন হয়নি। ভারতেও বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়।

আরও পড়ুন: একজন এমপির প্রত্যাশা উদ্ভট উটের পিঠে চলুক স্বদেশ!

‘ওয়েস্টমিনিস্টার মডেল অব ডেমোক্রেসি’ অনুসরণ করে সংসদের কাছে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা রেখে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে চেয়েছি। কিন্তু ব্রিটিশদের দ্বারা একসময় শাসিত দেশগুলোতেই এই পদ্ধতি অনুসরণের রেকর্ড জোরালো নয়। কমনওয়েলথভুক্ত ৪৮টি দেশের বিচারক নিয়োগ এবং অপসারণ পদ্ধতি নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মাত্র ১৬টি দেশে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে আছে। বাকি ৩২টি দেশে সংসদকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সে সব দেশে বিচারপতি অপসারণের জন্য ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

কমনওয়েলথ সচিবালয় ২০১৫ সালে গবেষণাটি প্রকাশ করেছে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, যেসব দেশের সংসদ বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পেয়েছে সেই সব দেশে বিচারক নিয়োগের জন্য নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত আলাদা কমিশন বা পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়েছে। ইংল্যান্ড, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশেই দীর্ঘ দিন থেকে ‘জুডিশিয়াল এপয়েন্টমেন্ট কমিশন’ কাজ করছে। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগের সময়ই তার যোগ্যতা, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, অতীত রেকর্ড সব কিছু পর্যালোচনা করা হয় যেন তাকে কখনো অপসারণের প্রয়োজনই দেখা না দেয়।

আরও পড়ুন: সংসদের বাইরে এমপিরা স্বাধীন!

কিন্তু আমরা গুরুত্ব দিয়েছি অন্যত্র। বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী না করে আমরা বিচারপতিদের অপসারণ পদ্ধতি নিয়েই সময় পার করেছি। আমাদের সংবিধান চার দশকের বেশি সময় ধরে বলছে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য আইন করার কথা যেন নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও বিতর্ক মুক্ত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই আইন করা হয়নি।

মামলায় হেরে যাওয়ার পর সরকারের উচিত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণ পদ্ধতির দ্রুত ফয়সালা করে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক করার উপায় খুঁজে বের করা। বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে যদি বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা যায়, যদি সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদেরকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায় তাহলে অপসারণের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। তখন বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা কার কাছে থাকলো সেটা মুখ বিষয় হবে না।

গণতন্ত্রের কথা বললে বিচারবিভাগের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করার কথা বলতে হবে। বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া নির্বাহী বিভাগের প্রভাব মুক্ত না হলে; বিতর্ক মুক্ত না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে না। স্বাধীন বিচার বিভাগ ছাড়া মুক্ত গণতন্ত্রও কল্পনা করা যায় না।

আরও পড়ুন: যে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি​

Comments

The Daily Star  | English
IMF loan conditions

IMF conditions: Govt pledges to track graft in tax admin

The government has pledged a series of sweeping reforms to meet International Monetary Fund conditions for the next instalment of its $5.5 billion loan, including a public survey to measure corruption in tax administration and a phased reduction of subsidies on electricity, fertiliser, remittances and exports.

6h ago