আমাদের এমপিরা সৌভাগ্যবান!

নিঃসন্দেহে আমাদের এমপিরা সৌভাগ্যবান! সংসদে অবারিত বাকস্বাধীনতা পেতে তাদেরকে কোনো সংগ্রাম করতে হয়নি; দীর্ঘদিন ধরে যে সংগ্রাম করতে হয়েছিল ব্রিটিশ এমপিদের। ওয়েস্টমিনিস্টার মডেলের সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী হিসেবে ব্রিটিশদের সংগ্রামের বিজয়ের সুফল আমাদের এমপিরাও ভোগ করছেন।
চলতি দশম জাতীয় সংসদে কোরাম সংকট
স্টার ফাইল ফটো

নিঃসন্দেহে আমাদের এমপিরা সৌভাগ্যবান! সংসদে অবারিত বাকস্বাধীনতা পেতে তাদেরকে কোনো সংগ্রাম করতে হয়নি; দীর্ঘদিন ধরে যে সংগ্রাম করতে হয়েছিল ব্রিটিশ এমপিদের। ওয়েস্টমিনিস্টার মডেলের সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসারী হিসেবে ব্রিটিশদের সংগ্রামের বিজয়ের সুফল আমাদের এমপিরাও ভোগ করছেন।

সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সময় আমাদের কোনো এমপি আদালত অবমাননা অথবা মানহানিকর মন্তব্য করলেও তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। কোনো এমপির বক্তব্যে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তাকে ক্ষোভ নিজের ভেতরেই পুষে রাখতে হবে প্রতিকারহীনভাবে। কেননা ব্রিটিশ এমপিদের মত তারাও যেকোনো বক্তব্যের জন্য দায়মুক্ত।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ এবং সংসদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ এমপিদেরকে রাজা-রানীর শাসন আমলে দীর্ঘ সংগ্রাম করার সময় অনেক দমন-পীড়ন সইতে হয়েছে। সে সময় সংসদের প্রাধিকার এবং দায়মুক্তি নিয়ে ব্রিটিশ আদালতের সাথেও এমপিদের দ্বন্দ্ব চলে। কেননা রাজতন্ত্রের সময় আদালত সংসদকে দায়মুক্তি এবং বিশেষ অধিকার নির্ধারণের সম্পূর্ণ ক্ষমতা দিতে অস্বীকার করেছিল।

কয়েকটি উদাহরণ স্মরণ করলেই সংসদ এবং রাজার দ্বন্দ্বের তীব্রতা অনুধাবন করা যাবে। রাজার শাসনের বিরুদ্ধাচরণ করার দায়ে ১৬৪২ সালের ৪ জানুয়ারি রাজা সেনাবাহিনী নিয়ে সংসদে প্রবেশ করেন পাঁচ জন এমপিকে গ্রেফতার করতে। ক্ষুব্ধ রাজা সংসদে প্রবেশ করে দেখেন সেই পাঁচজন এমপি অনুপস্থিত। স্পিকারের আসনে বসে রাজা; বলেন ‘দেখছি পাখিরা উড়ে গেছে।’ তারপর তিনি স্পিকারের কাছে পাঁচজন এমপির অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। কিন্তু স্পিকার সেটা জানাতে কৌশলে অস্বীকার করে যে বক্তব্য দেন তা আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। রাজার সামনে হাঁটু গেরে বসে তিনি জানান, দেখার জন্য তার চোখ নেই, কথা বলার জন্য নেই জিহ্বা। তিনি এই সংসদের সেবক। সংসদ যেমন আদেশ করে তিনি সে অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেন।

সংসদের প্রধান হিসেবে স্পিকারের ভূমিকাও ছিল অবিস্মরণীয়। তিনি ছিলেন সংসদের সভাপতি। সংসদে কী আলোচনা হত; কী প্রস্তাব গ্রহণ করা হত তিনি রাজা বা রানীকে সেসব অবহিত করতেন। এ দায়িত্ব পালনের জন্যই তাকে বলা হত স্পিকার বা প্রবক্তা। সেই থেকেই স্পিকার পদের সৃষ্টি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাজতন্ত্র এবং সংসদের সুদীর্ঘ সংগ্রামের সময় স্পিকারের জন্য এ দায়িত্ব পালন সুখকর ছিল না মোটেও। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেশ কয়েক জন স্পিকার রাজা বা রানীর রোষানলে পরে নির্মমভাবে নিহত, কারারুদ্ধ বা অন্যভাবে নিগৃহীত হন।

এ জন্য কেউ স্পিকার হতে চাইতেন না। হাউস অব কমন্স এ কাউকে স্পিকার নির্বাচিত করে তাকে টেনে হিঁচড়ে স্পিকারের আসনে বসান হত। তবে পদে বসার পর স্পীকার সংসদে মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট থাকতেন। এটাই রীতি হিসাবে দীর্ঘ দিন চলে। এমনকি ১৬৮৮ সালের সফল বিপ্লবের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সংসদের নিয়ন্ত্রণে আসার পরও এ রীতি কয়েক দশক অব্যাহত থাকে। অবশেষে ১৭২৮ সালে হাউস অফ কমন্সের নব-নির্বাচিত স্পিকার এ রীতি বর্জন করেন।

সংসদ এবং রাজতন্ত্রের মধ্যকার দ্বন্দ্বে সংসদ জয়ী হবার পর একজন রাজাকেও প্রাণ দিতে হয়েছে।

তবে নিজদের অর্জিত স্বাধীনতার যথেচ্ছ ব্যবহার ঠেকাতে ব্রিটিশ এমপিরা সচেষ্ট থেকেছেন বরাবর। অবারিত বাকস্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সংসদে যথেচ্ছভাবে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ ব্রিটিশ সংসদে নেই। সংসদ তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংসদে বক্তব্য নিয়ন্ত্রণে রেখে চলেছে। আপত্তিকর বক্তব্য রাখার জন্য অতীতে অনেক এমপিকে সংসদের নিকট ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। কোনো কোনো এমপিকে তিরস্কার করা হয়েছে। অনেককে শাস্তি পর্যন্ত পেতে হয়েছে। কয়েকজন এমপিকে সংসদ থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। বর্তমানে এমপিদের বিরুদ্ধে এমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আর নিতে হয় না। কেননা বিশেষ অধিকার ভোগকারী একজন ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেক সদস্য অন্যজনের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন।

আমাদের সংসদেও সদস্যারা যেন তাদের বিশেষ অধিকার যথেচ্ছ ভাবে ব্যাবহার না করেন সে জন্য সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সদ্যদের যথেচ্ছ বক্তব্য এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণে স্পিকারকেও যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কোনো এমপি আপত্তিকর মন্তব্য করলে স্পিকার তাকে থামিয়ে দিতে পারেন। আপত্তিকর বক্তব্য বাতিল করতে পারেন। তারপরও কোনো এমপি আপত্তিকর আচরণ করলে তিনি তাকে সংসদ থেকে বের করে দিতে পারেন।

আমাদের এমপিদের সৌভাগ্য যে এসব বিধিবিধান বইয়ের পাতায় রয়ে গেছে। বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই বলে অনেক এমপি সংসদে ফ্রি স্টাইল গালিগালাজ অব্যাহত রাখতে পেরেছেন। আর সে কারণে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা শুরু হবার পর থেকে আস্তে আস্তে সংসদীয় ভাষার অবনতি ঘটেই চলে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অশালীন এবং অশ্রাব্য ভাষার ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। গত নবম জাতীয় সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের এমপিদের বাহাসে এমন সব অশালীন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যেগুলো সংবাদপত্রে মুদ্রণ অযোগ্য ছিল। হতাশ এবং ক্ষুব্ধ কয়েক জন জ্যেষ্ঠ সদস্য এমন মন্তব্য করেছেন যে, বাসায় পরিবারের সদস্যদের সামনে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত সংসদের অধিবেশন শোনার অযোগ্য।

অতীতে অনেক এমপি সংসদে তাদের বিশেষ অধিকারের সুযোগ নিয়ে অনেক ব্যক্তিবর্গ যারা সংসদ সদস্য নন তাদের সম্পর্কেও প্রচুর অশালীন এবং কটু মন্তব্য করেছেন। সেই ধারা বদলায়নি। আদালত কর্তৃক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হবার পর গত রবিবার এমপিরা  সংসদে যে ভাষায় বিচার বিভাগ, প্রধান বিচারপতি এবং কয়েকজন আইনজীবীকে আক্রমণ করেছেন তাতেই প্রমাণিত হয় পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। অধিকার অর্জন চেয়ে রক্ষা করা যে কঠিন তা আমাদের এমপিরা প্রমাণ করে চলেছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Sri Lanka picks Marxist-leaning Dissanayake as president to fix economy

Sri Lanka's Marxist-leaning Anura Kumara Dissanayake was declared the winner of the debt-laden island nation's presidential election by the polling body on Sunday

2h ago