গণহত্যার স্মৃতি: যখন বেঁচে থাকাই আরও বেশি বেদনার

২৩ এপ্রিল, ১৯৭১।

দুপুরের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গিয়েছিল আচমকা গুলির শব্দে। পাকিস্তানি হানাদারদের উন্মত্ত গুলি থেকে বাঁচতে সেদিন পাবনার বাঘইল গ্রামের মানুষেরা চিৎকার করে জীবন বাঁচাতে দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন।

এই নারকীয়তার মধ্যে ফজিলা খাতুন তার ৮ মাসের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে এবং ৮ বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন।

ঘাতকের গুলির আঘাতে ছোট্ট মেয়েটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মারা যায় সেখানেই। মায়ের কাছে ছুটে আসতে গিয়ে পায়ে গুলি লাগে ৫ বছরের আরেক মেয়ের।

আব্দুল কাদের, তার স্ত্রী ও মেয়ে (ডান থেকে বামে)।

স্বামী আব্দুল কাদেরের গায়েও গুলি লাগে, রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ির কাছে পড়েছিলেন তিনি, সেদিনের ভয়াবহ গণহত্যার বর্ণনা দিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ফজিলা। যে গণহত্যায় কমপক্ষে ২৩ জন নিহত ও ৮ জন আহত হয়েছিলেন।

'আমার বড় মেয়েটা আমার সামনে মরে গেল। আমার স্বামী আর ছোট মেয়েটা গুলিতে পড়ে রইল,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন ফজিলা খাতুন।

'আমি আমার মরা মেয়েটার জন্য তখন কাঁদতেও পারিনি কারণ আমাকে আমার স্বামী আর গুলিবিদ্ধ ছোট মেয়েটাকে বাঁচাতে ছুটে যেতে হয়েছিল।'

পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর ছিল যে কেউ তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও সাহস পায়নি।

'সব কিছু শান্ত হলে আমি গ্রামের দোকান থেকে সিবাজল ট্যাবলেট কিনলাম, সেগুলো গুঁড়ো করে নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে আমার স্বামী আর মেয়ের ক্ষতে কয়েকদিন ধরে মলমের মতো ব্যবহার করলাম। কিছুদিন পর তারা সুস্থ হয়,' বলেন ফজিলা। 

ওমর আলী, মাত্র ৯ মাস বয়সের শিশুটি অলৌকিকভাবে সেদিন গণহত্যা থেকে বেঁচে গেলেও তার পরিবারের ৫ সদস্যকে হারায়।

গণকবরের পাশে ইউনুস আলী।

'পাকিস্তানি হানাদারেরা আমার বাবা উম্মেদ মন্ডল, মা হাওয়া বেগম, বোন সাকাতুন খাতুন এবং ভাই শফিকুল ইসলাম ও বাদাম মন্ডলকে হত্যা করে। আমি এতিম হয়ে যাই, বলেন সেদিনের বেঁচে যাওয়া ওমর।

ওমর এখন দিনমজুরের কাজ করেন থাকেন পাশের গ্রামে। গ্রামের মানুষের কাছ শুনেছেন, মায়ের কোলে ছিলেন ওমর যখন মা মারা যায়। 'স্থানীয়রা যখন আমাকে উদ্ধার করে তখন আমি আমার মায়ের লাশের পাশে কাঁদছিলাম।'

সেদিনের গণহত্যার বর্ণনা দেন বার্ধক্যজনিত জটিলতায় প্রায় শয্যাশায়ী আব্দুল কাদের। বলেন, এমন হামলার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।

'তখন বিকেল ৫টা, আমরা আমাদের রোজকার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সেইসময় পাকিস্তানি আর্মি আসে।'

তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে গ্রামবাসীদের জড়ো হওয়ার জন্য ডাকে। তারা বলে, তারা পরিবারের সদস্যদের কেবল গুণবে। কেউ আহত হবে না।

যারা সেখানে গিয়েছিল তাদের লাইন ধরে দাঁড় করানো হয়েছিল। তারপর হঠাৎ করেই গুলি চালানো শুরু করে। আমার কোমরের নিচে গুলি লাগে, বলছিলেন কাদের।

পাকশে ইউনিয়নের বাঘইল গ্রামের গণহত্যা হয়তো এখন ইতিহাসের একটা ঘটনা, কিন্তু কাদের এবং গ্রামের আরও অনেকের কাছে এটি একটি দুঃস্বপ্ন।

এখনও গুলির জায়গায় ব্যথা পাই, কিন্তু তারচেয়েও বড় কষ্ট, বড় বেদনার আমার মেয়ে আর অনেক আত্মীয়কে সেদিন হারানো, দমবন্ধ করা কণ্ঠে বলেন কাদের।

বাঘইল শহীদপাড়া নামে গ্রামটি পরিচিত। তবে, গ্রামবাসীরা জানান, যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের এখনও শহীদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি।

শহীদদের গণকবর রক্ষা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বলেও তারা দুঃখ করেন।

'সময়ের সঙ্গে গ্রামটা অনেক বদলে গেছে। কুঁড়েঘরের বদলে সুন্দর দালান, মাটির পায়ে হাঁটার পথ বদলে হয়েছে কংক্রিটের রাস্তা কিন্তু গণকবরের যত্ন নেওয়া হয়নি,' বলেন ইউনুস আলী। যিনি গণহত্যায় তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী জোৎস্না খাতুনকে হারিয়েছিলেন।

পাকশে ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কয়টি স্থানে গণহত্যা হয়েছে তার মধ্যে এটি একটি। কিন্তু এই গ্রামের শহীদদের যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

এ হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জানতে পারে এলাকার মানুষের দাবি সেটিই।

স্থানীয় স্কুলশিক্ষক আমিরুল ইসলাম বলেন, 'যুদ্ধাহতদের অধিকাংশই মারা গেছেন। আমাদের অবশ্যই গণকবর রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে এবং যুদ্ধের সাক্ষ্য নথিভুক্ত করতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Train staffers call off strike

The strike was withdrawn after the union received assurances that their demands would be addressed

2h ago