মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে দেশে নতুন কর্মসংস্থান

মাগুরা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের তড়িৎকৌশল বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করার পর আবদুল্লাহ আল নোমান আনিরা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি স্থানীয় মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরির প্রস্তাব পান। এখন তিনি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় মোবাইল অ্যাসেম্বলি প্রকৌশলী পদে কর্মরত আছেন।

মাগুরা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের তড়িৎকৌশল বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করার পর আবদুল্লাহ আল নোমান আনিরা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি স্থানীয় মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরির প্রস্তাব পান। এখন তিনি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় মোবাইল অ্যাসেম্বলি প্রকৌশলী পদে কর্মরত আছেন।

তিনি সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, 'আমি কখনো ভাবিনি এত সহজে চাকরি পেয়ে যাব।'

আরও অনেকের মতো তিনিও বাংলাদেশে স্মার্টফোন অ্যাসেম্বলি ও উৎপাদন বাড়ার কারণে তৈরি হওয়া বাড়তি কর্মসংস্থানের সুফল ভোগ করছেন।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকার এই খাতে বড় আকারের কর সুবিধা দেওয়ার পর থেকে হ্যান্ডসেটের স্থানীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা গেছে। ১৪টি কারখানা ইতোমধ্যে চালু হয়েছে এবং আরও চারটি কারখানা চালু হওয়ার পথে। ফলে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে, আমদানি করা হ্যান্ডসেটের ওপর ৫৮ শতাংশ কর প্রযোজ্য হয়। কিন্তু স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল বা উৎপাদন করা হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে কর মাত্র ১৫ শতাংশ।

আনিরা ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, 'কখনো কখনো আমরা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের চাকরির প্রস্তাব দেই। শুরুতে তাদেরকে কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শিগগির তারা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে যান।'

২০২২ সালের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠান আরও এক হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল ও উৎপাদন করা হ্যান্ডসেটের চাহিদা বাড়ার কারণেই মূলত তিনি কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে চাইছেন।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৯৪ লাখ হ্যান্ডসেটের মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

গত অর্থবছরে আমদানি করা ও উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১২ লাখ, যার মধ্যে প্রায় ৬৩ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত।

অ্যাসেম্বলি ও উৎপাদনে যুক্ত দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখানেই থামছে না। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান আরও ১০ হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

২০২১ এর শুরুতে কিছুটা মন্দাভাব থাকলেও অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ খাতে বিক্রির পরিমাণ জুলাই থেকে বাড়তে শুরু করে। এই শিল্প সংশ্লিষ্ট একটি পূর্বাভাষ অনুযায়ী, মহামারি আঘাত হানার পর এই খাতে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়তে থাকার কারণে মোবাইল ফোনের বিক্রি দ্রুত বাড়ছে। ফিচ রেটিং অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ২০২২ ও ২০২৩ অর্থবছরে যথাক্রমে ৭ ও ৭ দশমিক ২ শতাংশ হবে।

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন আমদানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মোবাইল ফোনের বিক্রি ও আয় যথাক্রমে ৮ ও ১৭ শতাংশ বেড়েছে। স্থানীয় উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে হ্যান্ডসেটের মূল্য প্রায় ৩৫ শতাংশ কমে এসেছে।

কারখানাগুলোতে অল্প কয়েকজন প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ও শীর্ষ কর্মকর্তা ছাড়া প্রায় সকল কর্মী বাংলাদেশি নাগরিক।

স্যামসাংয়ের স্থানীয় অ্যাসেম্বলি অংশীদার ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের কারখানায় প্রায় ১ হাজার ২৫০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন জানান, ২০২২ এর ডিসেম্বরের মধ্যে আরও এক হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে।

২০১৯ থেকে উৎপাদন শুরু করেছে গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন। প্রতিষ্ঠানটির এখন মাসে তিন লাখ হ্যান্ডসেট উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। গাজীপুরের বোর্ডবাজারে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় বর্তমানে ৬৫০ জনেরও বেশি কর্মী কাজ করছেন।

গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান আশরাফুল হাসান বলেন, 'আমরা ২০২২ এ সক্ষমতা ও কর্মীর সংখ্যা দ্বিগুণ করব।'

২০১৯ থেকে বেস্ট টাইকুন (বিডি) এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেশে ভিভো ফোন উৎপাদন শুরু করেছে।  বর্তমানে তারা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত কারখানা থেকে বাংলাদেশে ভিভো হ্যান্ডসেটের মোট চাহিদার ৯৯ শতাংশই পূরণ করছে।

প্রতিষ্ঠানটির ফিনান্স ও লজিস্টিকস সিনিয়র ম্যানেজার ইমাম উদ্দীন জানান, তাদের কারখানায় বর্তমানে ১ হাজার ২০০ মানুষ কাজ করছে এবং তারা আগামী বছর নাগাদ আরও ১ হাজার কর্মী নিয়োগ দেবেন।

এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রতি মাসে পাঁচ লাখেরও বেশি সিম্ফোনি ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট উৎপাদন করে। এই কাজে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষকে নিয়োগ দিয়েছে। গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় ২ হাজার কর্মী কাজ করেন। তারা মাসে ৫ লাখ ফোন উৎপাদন করেন। প্রতিষ্ঠানটি মাসে ২০ লাখ ফোন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে। এর জন্য তারা ২০২২ এর শেষ নাগাদ আরও ১ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

সম্প্রতি নোকিয়া ও শাওমি বাংলাদেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন শুরু করেছে।

স্থানীয়ভাবে উৎপাদন দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সাহায্য করছে

স্থানীয় উৎপাদন ও অ্যাসেম্বলি দেশের তরুণ-তরুণীদের উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ এনে দিয়েছে।

ন্যূনতম এইচএসসি পাশ করেই কারখানাগুলোতে কাজ পাওয়া যায়। তবে নিয়োগদাতারা তড়িৎকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমাধারীদের অগ্রাধিকার দেন।

লাইন ম্যানেজার থেকে ইউনিট ম্যানেজার পদে উন্নীত হওয়ার জন্য স্নাতক ডিগ্রী প্রয়োজন হয়। ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট এক্সিকিউটিভ অথবা কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার পদেও তারা নিয়োগ পেতে পারেন।

বেশিরভাগ অপারেটর (কর্মী) বিভিন্ন পলিটেকনিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হিসেবে পাশ করেছেন। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সাধারণত তাদেরকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বেস্ট টাইকুনের কর্মকর্তা ইমাম বলেন,  অনেক কর্মীকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হয়, যেমন চীনে। 

গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের হাসান জানান, তারা চীন থেকে যখন ফোন কিনে আনতেন, তখন ২ শতাংশ ফোন কারিগরি ত্রুটির কারণে ফেরত পাঠাতে হতো।

তিনি বলেন, 'এখন স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল করা ফোনের ক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ ফোনে ত্রুটি পাওয়া যায়। এতে প্রমাণ হয় স্থানীয় কর্মীরা নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করেছেন। গ্রাহকদের সন্তুষ্টিও বেশ ভালো।'

ভ্যালু অ্যাডিশনে সমস্যা

মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে ডিসপ্লে স্ক্রিন, চিপসেট ও ব্যাটারি মুখ্য যন্ত্রাংশ। ফোনে যতগুলো যন্ত্রাংশ থাকে তার মধ্যে এই তিনটির দামই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান এগুলো উৎপাদন করে না।

শুধুমাত্র তাইওয়ান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান চিপসেট নির্মাণ করে। স্যামসাং, বিওই টেকনোলজি ও এলজির মতো অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান ডিসপ্লে উৎপাদন করে।

এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, কিছু বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান দাবি করে তারা ব্যাটারি উৎপাদন করছে। কিন্তু এ দাবি সত্য নয়।

ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের মেসবাহ বলেন, 'ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ নবম স্থানে থাকলেও ভ্যালু অ্যাডিশনের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছি, কারণ বেশিরভাগ ব্যবহারকারী খুবই সাধারণ মানের ফোন ব্যবহার করেন।'

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের হাই-এন্ড ফোন কেনার ক্ষমতাও বাড়ছে এবং এই ধারায় ডিসপ্লে, ব্যাটারি ও চিপসেট নির্মাণের কারখানাও তৈরি হবে।'

হ্যান্ডসেট রপ্তানি: সুযোগ ও সমস্যা

ওয়ালটন ও সিম্ফনি ব্র্যান্ডের ফোন ইতোমধ্যে রপ্তানি হচ্ছে। এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষ ভাবছেন তৈরি পোশাক রপ্তানির মতো এই খাতেও রপ্তানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, 'একদিকে অনেক স্নাতক এই খাতে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। অপরদিকে এতে দেশের জন্য রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Dengue danger not over yet

As rain and thunderstorms are expected in various parts of the country over the next few days, experts warn that the dengue season could extend further this year.

1h ago