মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাব: জটিল অবস্থানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

হত্যা-নির্যাতন থেকে বাঁচতে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। ফাইল ফটো এএফপি

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা এবং দেশটিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে উত্থাপিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে বাংলাদেশ। ফলে, বাংলাদেশ মিয়ানমারে সামরিক শাসনে সমর্থন দিচ্ছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ এ ব্যাপারে রাশিয়া ও চীনের দলে কিনা, এমন প্রশ্নও উঠছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে (ইউএনএসসি) ‍ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের গণহত্যার মতো বিষয় থেকে, বিশেষ করে ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে এ দুটি দেশ খুব সামান্যই ভূমিকা রেখেছে। ওই সময় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

জাতিসংঘে উত্থাপিত প্রস্তাবটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো পশ্চিমা দেশগুলো। পরে এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনের (আসিয়ান) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এটি চূড়ান্ত করা হয়। গত ১৮ জুন প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। 

সব মিলিয়ে ১১৯টি দেশ এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। একমাত্র দেশ হিসেবে বিপক্ষে ভোট দেয় বেলারুশ।

বাংলাদেশ ছাড়াও, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া, বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভারত এবং আসিয়ানভুক্ত দেশ ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও লাওসসহ ৩৬টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রবাব ফাতিমা ভোট না দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত আছে বাংলাদেশের। দেশটির ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। সুতরাং রোহিঙ্গাদের জন্য একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজার ক্ষেত্রে মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ 

‘তবে, যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তা মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত সংখ্যালঘুদের, সুনির্দিষ্টভাবে বললে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়ার শর্ত তৈরির জরুরি প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে’, বলেন রবাব ফাতিমা। 

গত এপ্রিলে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে আসিয়ান নেতারা যে পাঁচটি বিষয়ে একমত হয়েছিলেন, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়েছে ‍জাতিসংঘের প্রস্তাবে।

তবে, ফাতিমা বলেছেন, ‘এটি প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করছে না।’ 

তার ওপর, সম্প্রতি মিয়ানমারের সামরিক নেতারা গণমাধ্যমে যেসব কথা বলেছেন, তাতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও স্থায়ীভাবে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো নীতিগত সংস্কারের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর ব্যর্থতা মিয়ানমারকে একটি দায়মুক্তির অনুভূতি দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন ফাতিমা।

নিপীড়িত হয়ে ১৯৮০ সাল থেকেই মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।

এ ব্যাখ্যা কি সন্তোষজনক? প্রস্তাবটির ব্যাপারে কি ভিন্নভাবে কাজ করতে পারতো বাংলাদেশ? 

বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকের মতে, বাংলাদেশ সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে বিশ্ব তেমন কিছু করেনি বললেই চলে। কিন্তু, গত চার দশক ধরে বিষয়টি নিয়ে চরম দুর্ভোগে আছে বাংলাদেশ। তাদের জন্য রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে, অন্য বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘের প্রস্তাবটি মিয়ানমারের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থাকবে এবং এ প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকায় বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান প্রতিফলিত হয়নি।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের মতে, রোহিঙ্গা গণহত্যা, তাদের নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবাসনের কথা উল্লেখ না থাকায়  জাতিসংঘের প্রস্তাব অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মিয়ানমারে যে ধরনের অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী গণহত্যা, ধর্ষণ এবং রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি গুরুতর অপরাধ করেছে। প্রস্তাবে পশ্চিমা বিশ্ব বিষয়টি এড়িয়ে গেছে- এটি বিস্ময়কর।’

বাংলাদেশ প্রস্তাবে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করলেও, তা উপেক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া, প্রস্তাবটিতে একটি সর্বাঙ্গীণ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়নি। সর্বসম্মতিক্রমেও গৃহীত হয়নি এ প্রস্তাব।

‘সুতরাং বাংলাদেশের ভোটদানে বিরত থাকার অর্থ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একটি শক্ত অবস্থানে থাকা’, যোগ করেন তৌহিদ হোসেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘চীন, রাশিয়া ও ভারতসহ রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে এমন বেশ কয়েকটি আসিয়ানভুক্ত দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে এবং বাংলাদেশের এতে ভোট দেওয়ার কোনো কারণ নেই।’ 

সবসময় পশ্চিমা সমর্থন পাওয়া অং সান সু চি আসলে ক্ষমতায় থাকাকালীন রোহিঙ্গা গণহত্যাকে সমর্থন দিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে সামরিক জান্তাকে রক্ষা করেছেন।

‘জাতিসংঘের প্রস্তাবটির রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকলেও, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই এটির’, বলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।

‘মিয়ানমার বছরের পর বছর ধরে সামরিক জান্তার শাসনে ছিল এবং জান্তার বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তিগুলোর নিষেধাজ্ঞা কাজে আসেনি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সুতরাং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করাই বাংলাদেশের জন্য ভালো।’

এ ছাড়া, প্রস্তাবটির পক্ষে কাজ করা বেশিরভাগ দেশই মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে গেছে এবং এখনো দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখছে। 

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘এর অর্থ হচ্ছে, তারা তাদের বক্তব্যের ব্যাপারে আন্তরিক নয়।’

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সোচ্চার। কিন্তু, জাতিসংঘের প্রস্তাবে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তাই বাংলাদেশ যা করেছে, ঠিক করেছে বলে মত দেন তিনি।

তবে, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের সভাপতি এম হুমায়ুন কবির এ ব্যাপারে ভিন্ন মত দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেই ভালো করতাম আমরা। কারণ, ভোট না দেওয়ার মাধ্যমে একটি ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের গত ৫০ বছরের কূটনীতির দিকে তাকান। নীতিভিত্তিক ছিল এ কূটনীতি। গণতন্ত্র, মানুষের অধিকারের পক্ষে নীতিগত অবস্থান ছিল আমাদের।’ 

যেসব পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশকে মানবিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে, তারাও ভোট না দেওয়ার বিষয়টিতে বিস্মিত হয়েছে। ভবিষ্যতে তারা বিষয়টি কীভাবে দেখবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন হুমায়ুন কবির। 

অন্যান্য দেশের ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের নীতি বিবেচনা করে দেখতে হবে, অন্যরা কী করছে তা নয়।’

‘বাংলাদেশ ভোট দিতে পারতো এবং তারপর নিজেদের অভিযোগ ও দাবি ব্যাখ্যা করতে পারতো’ বলে মত দিয়ে তিনি বলেন, ‘তাহলে এটির রেকর্ড থাকতো। আমাদের নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট থাকতো।’

‘বেশিরভাগ দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। আমরাও পক্ষে ভোট দিলে, মিয়ানমার বিষয়টি পছন্দ করতো না। বাস্তবে, মিয়ানমার এমনিতেই আমাদের ব্যাপারে খুব একটা খুশি না। তাহলে নীতির ব্যাপারে আপোষ করব কেন আমরা?’, প্রশ্ন রাখেন হুমায়ুন কবির। 

বাংলাদেশের এ কাজের ফলে বিশ্বের সঙ্গে এবং মিয়ানমারের সঙ্গেও কূটনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বলে মত দেন তিনি।

নাম গোপন রাখার শর্তে সাবেক আরেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, এটির আন্তর্জাতিক একটি গুরুত্ব আছে, যা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে।’

তার মতে, ভোট দেওয়ার পর নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারতো বাংলাদেশ। 

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

$14b lost to capital flight a year during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

10h ago