চাঁদে জমি কেনা: জালিয়াতি না বাস্তবতা?
চাঁদকে মানুষ পেতে চেয়েছে নানা রূপে, নানা উপলক্ষে। আমাদের রূপকথার চাঁদে ছিল চরকা কাটা বুড়ি। কোনো গল্পে চাঁদের জন্ম-মৃত্যু হতো প্রতি মাসে। নতুন চাঁদ মানে জন্ম। আর পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যার দিকে যেতে থাকা মানে চাঁদের মৃত্যুর দিকে এগুনো। নিছকই কল্পনা এসব।
লাখ-লাখ কিলোমিটার দূরের চাঁদ ছিল চিরকালীন আরাধ্য বস্তু। কল্পবিজ্ঞান লেখক জুলভার্ন পৃথিবীর সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়ার কল্পনা তুলে ধরেছিলেন 'ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন' বইয়ে অভিযাত্রীদের চাঁদের কক্ষপথে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। তার ১০৪ বছর পর সত্যি সত্যি মানুষ চাঁদে পা রাখে। হাজারো কল্পনার চাঁদ ধরা দেয় বিজ্ঞানের প্রচেষ্টা আর মানুষের সাহসিকতার কাছে। সঙ্গত কারণে চাঁদে অভিযান থেমে গেছে। তবে মানুষ কিন্তু বসে নেই। চাঁদে কীভাবে বসবাস করা যায়, সেই বিষয়ে ঠিকই গবেষণা করছে। যদিও, বাতাস ও পানিবিহীন এই উপগ্রহে নিকট ভবিষ্যতে মানুষের বসতি গড়ার সম্ভাবনা খুব কম।
আধুনিক বিশ্বের মানুষের কাছে চাঁদ কেবল কল্পনা কিংবা সাহিত্যের মাঝে আটকে নেই। রূপকথা আর গল্প থেকে বেড়িয়ে চাঁদ হয়ে উঠছে বৈষয়িক।মানুষের আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তির উপর গড়ে ওঠা আস্থাকে ঘিরে চাঁদ যেনো হয়ে উঠেছে ব্যবসার ঘুঁটিও। চাঁদ নিয়ে সাম্প্রতিক হইচই সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
মহাকাশ জয়ের শুরুটা রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে। স্নায়ুযুদ্ধের ফলে সেসময় একটি চিন্তা জেগে ওঠে। মহাকাশ না আবার দখলদারিত্বের কবলে পড়ে যায়! ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে সহিংসতা, বৈষম্য, অত্যাচার ও শোষণ দেখেছে পৃথিবী। মহাকাশেও কি এমনটা হতে পারে?
এমন আশঙ্কা থেকে হয় 'আউটার স্পেস চুক্তি'। এতে বলা হয়, কোনো রাষ্ট্রই মহাকাশের কোনো বস্তু, গ্রহ বা চাঁদকে নিজের বলে দাবি করতে পারবে না। তবে, চাঁদ বা গ্রহ আবিষ্কার এবং মহাকাশের রহস্য উন্মোচনের দুয়ার সবার জন্যই খোলা থাকবে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১১টি দেশ এ চুক্তিতে সই করেছে।
অতীতে বহু লোক চাঁদের মালিকানা দাবি করেছে। তবে, ১৯৮০ সালে ডেনিস হোপ নামের এক মার্কিন নাগরিক শুধু চাঁদের মালিকানা দাবি করেই থামলেন না। চাঁদের জমি বেচাকেনার জন্য কোম্পানিও গঠন করে ফেললেন তিনি। তার মতে, কোনো ব্যক্তি চাঁদের মালিকানা দাবি করতে পারবে না, এমন কোনো কথা আউটার স্পেস চুক্তিতে উল্লেখ নেই। এই অপব্যাখ্যা খাটিয়ে চাঁদের জমি বিক্রির প্রচারও চালাতে থাকলেন তিনি। ১৯৯৫ সাল থেকে ডেনিস হোপ কেবল এ উৎস থেকেই আয় করছেন। তার দাবি, এখন পর্যন্ত এ খাত থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন তিনি!
তবে, ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কার মহাকাশ আইন বিষয়ক অধ্যাপক ফ্রান্স ভন ডার ডাঙ্ক বলেন, হোপের এ দাবি ভুয়া ও এক ধরনের জালিয়াতি। যে জিনিসের মালিকানারই ঠিক নেই, তার বেচাকেনারও ভিত্তি নেই। নিজেদের ইচ্ছেমত কিছু কাগজপত্র তৈরি করে এবং সফটওয়্যারে তৈরি কোনো ফাইলের মাধ্যমে চাঁদ, মঙ্গল বা অন্য কোনো গ্রহের জমির মালিকানা দাবি করা যায় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাকাশ ও চাঁদ বিষয়ক চুক্তিগুলো এখন অচল হয়ে গেছে। এগুলো হালনাগাদ করা প্রয়োজন। ১৯৬৭ সালের প্রেক্ষাপটে চুক্তির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশে সামরিক শক্তি এবং নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার না করা। তবে বর্তমানে বহু দেশ, এমনকি কিছু কোম্পানিও চাঁদে অভিযানের পরিকল্পনা করছে। তাই চাঁদের সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে নানাভাবে।
মানুষ কেন অর্থ ব্যয় করছে?
একটা সময় 'চাঁদে জমি কেনা' অভিনব উপহার হিসেবে বিবেচিত হতো। এক সাক্ষাৎকারে হোপ বলেছিলেন, সাধারণত অভিনবত্বের কারণেই মানুষ এর পেছনে অর্থ ব্যয় করে।
কোনো কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চাঁদে জমি কেনাকে এক ধরনের 'আশাবাদ' হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এর সঙ্গে আশাবাদী মানসিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। চাঁদে জমি কেনা অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।
মহাকাশ নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের বিষয়টি চিরকালীন। মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথের সঙ্গে মানুষের জীবনের ভবিষ্যত নির্ধারণের কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও মানুষ জ্যোতিষীর কাছে যায়। মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের জমি কেনার ব্যাপারটিকেও এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। মালিকানার ভিত্তি না থাকলেও একদল মানুষ সেখানে জমি বিক্রি করছে। মানুষ তা আগ্রহ নিয়ে কিনছেও। এখানে আসলে জমি নয়, এক ধরনের রসিকতা বা অভিনব কিছু একটা করার মানসিকতা কাজ করছে। বিক্রেতা আসলে মানুষের কাছে অভিনব ধারণা বিক্রি করছেন, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। আর এ কারণে ব্যক্তির অর্থ তো অপচয় হচ্ছেই, পাশাপাশি তিনি একটি জালিয়াতিরও অংশ হয়ে ওঠছেন।
তথ্যসূত্র:
Extraterrestrial real estate - Wikipedia
The Man Who Sells the Moon | Op-Docs | The New York Times
Who owns the moon? It's 'complicated,' say experts - CNN.com
Can You Really Become a Mars Land Owner?
Who owns the Moon?
Dennis M. Hope Has Owned the Moon Since 1980 Because He Says So
Fact check: Dennis Hope's sale of land on the moon isn't legal
Indians are buying plots on the moon, and the reasons are strangely familiar
Comments