শ্রমিক সংকটে মালয়েশিয়া

কাজ করছেন মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকরা। ফাইল ছবি

তীব্র শ্রমিক সংকটে পড়েছে মালয়েশিয়া। এ মুহূর্তে দেশটিতে উৎপাদন, পাম প্ল্যান্টেশন এবং নির্মাণ খাতে অন্তত ১২ লাখ শ্রমিকের ঘাটতিতে রয়েছে। 

সরকারি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় পরিস্থিতি যত স্বাভাবিক হচ্ছে, কর্মী সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। এর মধ্যে কারখানাগুলোতে দরকার অন্তত ৬ লাখ শ্রমিক, নির্মাণ শিল্পে সাড়ে ৫ লাখ, পাম তেল শিল্পে এক লাখ ২০ হাজার এবং চিপ উৎপাদন শিল্পে ১৫ হাজার কর্মী প্রয়োজন। এমনকি মেডিকেল গ্লাভস তৈরির কারখানাগুলোও উৎপাদন বাড়াতে অন্তত ১২ হাজার শ্রমিক প্রয়োজন।

তীব্র শ্রমিক সংকটের কারণে পাম তেলের বাগান থেকে শুরু করে সেমিকন্ডাক্টর কারখানাগুলো নতুন অর্ডার নিতে পারছে না। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের পণ্যের অর্ডার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হুমকির মুখে পড়েছে। 

রপ্তানি-নির্ভর দেশ মালয়েশিয়া গত কয়েক দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ দেশের কারখানা, পাম বাগান এবং পরিষেবা খাত গড়ে উঠেছে মূলত বিদেশি শ্রমিকদের শ্রমের ওপর নির্ভর করে। তার কারণ মালয়েশিয়ানরা এসব কাজকে নোঙরা, ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টকর বলে মনে করেন।

এদিকে মালয়েশিয়ার আয়ের এক চতুর্থাংশ আসে শিল্প খাতের উৎপাদন থেকে। কিন্তু এখন শ্রমিক সংকটে পড়ে এসব শিল্প কারখানার উৎপাদন থমকে আছে। বিশ্বব্যাপী চিপের ঘাটতি থাকার পরও মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলো যোগান বাড়াতে পারছে না। কারখানা মালিকরা শঙ্কায় আছেন, এভাবে ক্রেতা ফেরাতে হলে তারা হয়তো আর মালয়েশিয়ায় ফিরবেন না।

সাড়ে ৩ হাজারের বেশি কোম্পানির প্রতিনিধিত্বকারী ফেডারেশন অব মালয়েশিয়ান ম্যানুফ্যাকচারার্সের সভাপতি সোহ থিয়ান লাই বলেন, 'গত কিছুদিনে আশা জাগানোর মতো অনেক বিষয় আছে, আমাদের বিক্রিও বাড়ছে। কিন্তু আমাদের অনেক কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে।'

বিশেষ করে পাম তেল কোম্পানিগুলো খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন ইউনাইটেড প্ল্যান্টেশনের প্রধান নির্বাহী পরিচালক কার্ল বেক-নিলসেন। তিনি বলেন, 'পরিস্থিতি খুব খারাপ। বিষয়টা অনেকটা এরকম, আপনাকে ১১ জনের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলতে হবে, কিন্তু আপনার দলে মাঠে নামার মতো আছে কেবল ৭ জন।'

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স এপ্রিলের ৫১.৬ পয়েন্ট থেকে মে মাসে ৫০.১ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ২০২০ সালের অগাস্টের পর সেখানে কর্মী কমেছে সবচেয়ে বেশি, ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির গতি থমকে গেছে।

মালয়েশিয়ার সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অং সিউ হাই বলছেন, কর্মীর অভাবে তাদের চিপ তৈরির কারখানাগুলোকে ক্রেতা ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। মালয়েশিয়ার মানুষ এ ধরনের কারখানায় কাজ করতে চায় না। যারা কাজে ঢোকে, তারাও ৬ মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেন।

দেশটির অর্থনীতিতে পাম তেলের অবদান ৫ শতাংশ। কিন্তু শ্রমিকের অভাবে সময়মতো তুলতে না পারায় অনেক ফল এবার গাছেই পচেছে। তাতে এ বছর উৎপাদন ৩০ লাখ টন কমে যেতে পারে, তাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ বিলিয়ন ডলার। শ্রমিক সংকট অব্যাহত থাকলে রাবার গ্লাভস শিল্প এ বছর ৭০ কোটি টাকার আয় হারাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কূটনীতিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড মহামারি পরিস্থিতিতে বিদেশি শ্রমিক আনার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা গত ফেব্রুয়ারিতে  তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু অনুমোদন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং শ্রমিকের সুরক্ষা নিয়ে ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় ধীর গতির কারণে খুব বেশি বিদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় ফিরতে পারেননি।

এই শ্রমিক সংকটের মালয়েশিয়ায় অর্থনীতি কতটা ক্ষতির মুখে পড়ছে, সে বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেয়নি দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। যারা বিদেশি কর্মী নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন করে।
গত এপ্রিলে মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারভানান বলেছিলেন, বিভিন্ন খাতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার বিদেশি কর্মীর চাহিদার বিপরীতে মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে ২ হাজার ৬৫ জন কর্মীকে।

যারা অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়েছে বা যেসব ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার নিয়ম মানা হয়নি, সেসব আবেদন নাকচ করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় বিদেশি শ্রমিকের ২ বড় উৎস ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বলেছেন, তাদের কাছে শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে, এ কারণেও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই করে মালয়েশিয়ান সরকার। চলতি মাসের শুরুতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানানের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। 

চুক্তি অনুযায়ী প্রথম বছরেই ২ লাখ কর্মী যাওয়ার কথা রয়েছে। চলতি মাস থেকেই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো শুরু হবে বলে ঘোষণা দেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। সেই ঘোষণা অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় দ্রুত কর্মী পাঠাতে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর  বিরামহীর কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএমইটির ডাটা ব্যাংকের মাধ্যমে জেলায় জেলায় নিবন্ধন শুরু হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী বলেছেন, 'কর্মীরা বেশি টাকা দিয়ে বিদেশ গেলে সেই টাকা তুলতে পারেন না। তাই এই বেশি টাকা নেওয়া আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না। মালয়েশিয়ার বিষয়ে আমরা সেইভাবে পদ্ধতি ঠিক করছি, যাতে কর্মীরা সর্বনিম্ন খরচে যেতে পারেন।'
 
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার গত ২ বছরে মালয়েশিয়ার ৭টি কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কারণ শ্রম শোষণ ও কর্মীদের নিপীড়নের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূদত হারমোনো বলেছেন, 'দুই দেশের সাম্প্রতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেও কর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি এসেছে।'

তবে মালয়েশিয়ার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ক্রুটি আছে- এমন অভিযোগ মানতে রাজি নন দেশটির মানবসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী এম সারভানান।

চলতি মাসের শুরুতে ঢাকা সফরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, তার দেশ বাংলাদেশ সরকারকে আশ্বাস দিয়েছে, শ্রমিকদের ভালো বেতনের পাশাপাশি তাদের অধিকারের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।

'শ্রমিকরা বিনা খরচে যাবে। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ওখানকার নিয়োগদাতারা খরচ দেবে', বলেছেন সারাভানান ।

শ্রমিক নিয়োগের প্রযুক্তিগত বিষয় এবং নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে গত সপ্তাহে কয়েকটি দেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সরকার চুক্তি করেছে বলেও জানান সারভানান।

 

লেখক:  মালয়েশিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক

 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

4h ago