কলকাতায় উড়োজাহাজের ভেতরে আটকে থাকা দুর্বিষহ ৪ ঘণ্টা
কলকাতা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছাতে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন দেড় শতাধিক যাত্রী। ৪৫ মিনিটের যাত্রা তাদের শেষ হয়েছে ৬ ঘণ্টায়। ইমিগ্রেশন ছাড়াও এই সময়ের পরে তাদের আরও এক ঘণ্টা লেগেছে লাগেজ পেতে।
টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে উড়তে পারছে না উড়োজাহাজ, সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স না থাকায় তারা নামতেও পারছেন না উড়োজাহাজ থেকে। সব মিলিয়ে উড়োজাহাজে কেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে শেয়ার করেছেন ফ্লাইটটির একজন যাত্রী ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ শওকাত হোসেন।
কী হয়েছিল জানতে চাইলে শওকাত হোসেন বলেন, 'বিমানের বিজি-৩৯৬ ফ্লাইটটি কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৮টা ৩৫ মিনিটে ছাড়ার কথা ছিল। ফ্লাইটে বিজনেস ও ইকোনমি ক্লাসের একটি সিটও খালি ছিল না। সময়মতো ফ্লাইট এসেছে, সময়মতো সবাইকে অন বোর্ড করেছে।'
'উড়োজাহাজের দরজা বন্ধ করার পর যখন তা স্টার্ট করেছে, এর কিছুক্ষণ পরে তারা বলল, "দুঃখিত, টেকনিক্যাল কারণে কিছুক্ষণ সময় লাগবে। ধৈর্য ধরে বসার জন্য অনুরোধ করছি"।'
'টেকনিক্যাল সমস্যার কথা বলে তারা তাদের সেই বিখ্যাত খাবার সবাইকে দিয়ে দিলো। বিখ্যাত বলছি কারণ, বহু বছর ধরে এই একই খাবার দিচ্ছে বিমান। বুদ্ধি করে খাবারটি তারা দিয়েছে সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য। এরপর প্রায় ৪৫ মিনিট বা ১ ঘণ্টা পরে জানালো, সমস্যার সমাধান তারা করতে পেরেছে। এখন রওনা দেবে। ফ্লাইট অ্যানাউন্সমেন্টও দিয়েছে।'
'আস্তে আস্তে তারা উড়োজাহাজ নিয়ে রানওয়েতে যায়। রানওয়ে থেকে ওড়ার কিছুক্ষণ আগেই আবারও বললো, "দুঃখিত, আবারও টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছে। আমরা বে-তে ফেরত যাচ্ছি।" তারা আর টার্মিনালে ফেরেনি। এর এক ঘণ্টা পর জানালো সমস্যার সমাধান হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে উড়োজাহাজের ইলেকট্রিসিটি মাঝে মাঝে চলে যায়, আবার আসে। এসি বন্ধ। এর কারণ হিসেবে তারা বলছিল, গ্রাউন্ডের ইলেক্ট্রিসিটি কানেকশন পাচ্ছিল না। এভাবেই সময়টা কেটেছে।'
এ ধরনের সমস্যা সমাধানে উড়োজাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে কেন নেওয়া হলো না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'রাত ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে বিমানের ক্রুদের বললাম, ঢাকা থেকে আরেকটি উড়োজাহাজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। মাত্র তো ৪৫ মিনিট সময় লাগে।'
'যাত্রীদের তারা টার্মিনালেও নিচ্ছে না। ততক্ষণে রাত ১১টার বেশি বেজে গেছে।ক্রুরারা জানায়, সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ায় ওরা যাত্রীদের টার্মিনালে নামাতেও পারছে না।'
'এত সময় যেহেতু লাগছে, টেকনিক্যাল সমস্যা হচ্ছে, তারা ফ্লাইট ক্যানসেল করে আমাদের হোটেলে নিয়ে যেতে পারত। কিংবা টার্মিনালে বসতে দিতে পারত, সমস্যার সমাধান হলে আমরা আবার ফ্লাইটে উঠতাম। যাত্রীরাও সবাই সেটাই বলছিলেন। কিন্তু ক্রুরা বলছিলেন, সরি স্যার, আমরা বিমানবন্দরে উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা পাচ্ছি না, যারা সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স দেবে।'
এতটা দীর্ঘ সময় উড়োজাহাজের ভেতরে আটকে থেকে যাত্রীদের অবস্থা কী হয়েছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এরমধ্যে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন, উড়োজাহাজের দরজা বন্ধ থাকায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন ছিল না। যাত্রীরা হাতের কাছে সুবিধাজনক যা পেয়েছেন—বই, কাগজ, লিফলেট—তাই দিয়ে বাতাস করছিলেন। একজন অসুস্থ ছিলেন, তার জন্য ডাক্তার আনতে হয়েছে। সেসময় উড়োজাহাজের দরজা খুলেছে। ফ্লাইটের ভেতরে এত মানুষ, সবাই ঘেমে অস্থির। এর মধ্যে রাত সাড়ে ১১টা বেজে গেছে। খাবার নেই। যা ছিল সেটা আগেই দিয়ে দিয়েছে। মাত্র ৪৫ মিনিট ফ্লাইট টাইমের ফ্লাইটে তো আর এরচেয়ে বাড়তি খাবার থাকে না।'
'ওভাবে যদি আরও ২-১ ঘণ্টা আমাদের থাকতে হতো, তাহলে অনেকেই ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়তেন। অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন টেকনিক্যাল সমস্যার কথা চিন্তা করে।'
'ফ্লাইট থেকে ৩ জন নারী নেমে গিয়েছিলেন।'
'বিমানের ফ্লাইটে আটকানোর অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে। কিন্তু, এবারে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে আমাদের যাত্রীরা অত্যন্ত সহনশীলতার সঙ্গে পুরো ব্যাপারটি মেনে নিয়েছেন। উড়োজাহাজের টেকনিক্যাল সমস্যার কথা শুনতে পেয়ে তৈরি হওয়া উৎকণ্ঠা, এভাবেই উড়তে হলে কোনো বিপদ হবে কি না সেই আতঙ্ক, বদ্ধ উড়োজাহাজে এসি ছাড়া আটকে থাকতে হয়ে অপর্যাপ্ত অক্সিজেনে অসুস্থ হয়ে পড়া, ঘেমে অস্থির হয়ে পড়ার পরও তারা সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। কেবিন ক্রু বা উড়োজাহাজে থাকা বিমানের কারো সঙ্গে কেউ কোনো ধরণের খারাপ ব্যবহার করেননি, কেউ রাগারাগিও করেননি। এত সমস্যার পরেও তারা যে ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই অসাধারণ। তারা বলছিলেন, টেকনিক্যাল সমস্যা তো হতেই পারে,' যোগ করেন তিনি।
শওকাত হোসেন বলেন, 'খবরটি জানাতে আমি বাংলাদেশের কয়েকজন সাংবাদিককে কল করি। ভেবেছিলাম, ঢাকায় খবরটি প্রচারিত হলে বিমানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কানে সেটা যাবে। তারা হয়তো এখানে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স নেওয়া বা বিকল্প ফ্লাইটের ব্যবস্থা করবে। কয়েকজন সাংবাদিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, আমি ফ্লাইটের ভেতর থেকে ছবিও পাঠিয়েছি।'
'এই খবর যখন ঢাকায় প্রচার হচ্ছে, ততক্ষণে প্রায় রাত ১২টা বেজে গেছে। তার মানে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেছে। উড়োজাহাজের ভেতরে তখন অসহনীয় অবস্থা।'
ফ্লাইটের ক্রুদের সঙ্গে কী ঢাকার যোগাযোগ ছিল না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ঢাকা অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেই জানাচ্ছিলেন এয়ার হোস্টেসরা। এয়ার হোস্টেসরা চেষ্টা করছিলেন সাধ্যমতো সবাইকে সেবা দেওয়ার।'
শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট ছাড়লো কখন? শওকাত হোসেন বলেন, 'রাত সাড়ে ১২টার দিকে তারা বলল, "আমরা প্লেনটা ফিক্স করতে পেরেছি। এতক্ষণ তো উড়োজাহাজটি স্টার্ট করা ছিল, ফুয়েল পুড়েছে। পুনরায় ফুয়েল রিফিল করে তারপর ফ্লাই করব।" ইতোমধ্যে স্টেশন ম্যানেজার এসেছিলেন, আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপর ফুয়েল নিয়ে তারা ফ্লাই করেছে। আমরা ঢাকা এসে পৌঁছালাম ভোররাত আড়াইটার দিকে।'
'বিমানের ক্রু যারা ছিলেন, তারা বারবার দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স না থাকায় আমাদের কিছু করার ছিল না। কলকাতা এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি অফিসাররা সবাই বাড়ি চলে গিয়েছিল। যে কারণে ডিসিশন দেওয়ার মতো কেউ ছিল না।'
একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্সের জন্য যাত্রীদের এমন হয়রানির মধ্যে পড়তে হবে? এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সিকিউরিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কেউ থাকবে না, এটা আমার কাছে লজিক্যাল মনে হয়নি। কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি রাজ্য সরকার নয়, কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করে। একটি দেশের একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সবাই বাড়ি চলে গেছে—এই ধরণের গল্প বিশ্বাসযোগ্য নয় মোটেই।'
তিনি আরও বলেন, 'বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগাযোগ করলে নিশ্চই এর সমাধান করতে পারতেন। বিমানবন্দরে যোগাযোগ করে সমাধান না পেলে দূতাবাস পর্যায়ে যোগাযোগ করা যেত। বাস্তবে আমাদের যাত্রীরা নিজ দেশের প্রতিষ্ঠানটির প্রতি যতটা সহনশীলতা দেখিয়েছেন, যাত্রীদের প্রতি ঠিক ততটাই অবজ্ঞা দেখিয়েছেন বিমানের কর্তারা। এতগুলো যাত্রীর প্রতি, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রোগী, বিমানের কর্মকর্তাদের কোনো প্রকার সংবেদনশীলতা দেখতে পাইনি। যদি থাকত তাহলে নিশ্চই এভাবে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হতো না।'
ঢাকা পৌঁছানোর পর বিমানের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেখা করেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'না, বিমানের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। এতটা কষ্ট করে যাত্রীরা এলো, তাদের সমস্যা লাঘবের কোনো ব্যবস্থাও তারা করেনি, আবার কর্মকর্তাদের কেউ-ই বিমানবন্দরে একবার দেখতেও আসেননি। এটাই স্পষ্ট করে যে, যাত্রীদের প্রতি তাদের উদাসীনতা, গাফিলতি ঠিক কতটা।'
এই যাত্রায় মোট কতটা সময় লাগল, সে বিষয়ে তিনি বলেন, 'সাধারণত আমি এয়ারপোর্টে একটু আগেই চলে যাই। রাত সাড়ে ৮টার ফ্লাইটটি ধরতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে। ঢাকায় বাসায় এসে পৌঁছেছি ভোররাত সাড়ে ৪টায়। কলকাতা থেকে উড়োজাহাজে ওঠার পর ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগার কথা ৪৫ মিনিটের মতো। সেই ৪৫ মিনিটের বদলেই সময় লেগেছে ৬ ঘণ্টা। এর সঙ্গে ইমিগ্রেশনসহ বাকি কাজের সময় তো ছিলই।'
লাগেজ পাওয়ার বাড়তি তিক্ততার কথা যোগ করে তিনি বলেন, 'এত কিছুর পরেও ঢাকায় এসে আমাদের আরও ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে লাগেজের জন্য। আড়াইটার দিকে আমরা নামলাম, আর লাগেজ হাতে পেলাম সাড়ে ৩টার দিকে। এই এক ঘণ্টা আর কলকাতায় উড়োজাহাজে ওঠার পর থেকে ঢাকায় নামা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা হিসাব করলে মোট ৭ ঘণ্টার এক দুর্বিষহ যাত্রা ছিল এটি। একটি ফ্লাইটে যখন এত সমস্যা হয়েছে, সবাই যেটা জানে, সেখানে ঢাকায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের যারা করেন, তাদের তো আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা উচিত ছিল। যেন যাত্রীদের আরও হেনস্তা হতে না হয়। যাত্রীদের প্রতি ঠিক কতটা উদাসীনতা থাকলে এমনটি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।'
'সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পর এই ফ্লাইট সম্পর্কে মনিটরে লেখা দেখেছি, ফ্লাইট ইজ অন-টাইম।'
Comments