বেলা’র আইনি নোটিশের পরও লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে সড়ক নির্মাণ চলছে
মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলার লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে সড়ক নির্মাণ বন্ধ রাখতে স্থানীয় বন বিভাগ ৩ দফা চিঠি দিলেও পাকা সড়ক নির্মাণের কাজ চলছেই। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নির্দেশে বনের ভেতর সড়কের কাজ আবার শুরু হয়েছে।
সংরক্ষিত বনে এলজিইডির সড়ক পাকাকরণের কাজসহ বন বিরুদ্ধ সকল কার্যক্রম বন্ধের দাবিতে সরকারের ২ জন সচিবসহ ১০টি দপ্তরে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)।
গত ২২ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টারে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
এলজিইডি ও বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২ মাস আগে জুড়ি উপজেলার লাঠিছড়া থেকে রূপাছড়া বনের মধ্য দিয়ে ১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের টেন্ডার দেয় এলজিইডি।
বনের সড়কে ইট রাখা হলে বিষয়টি বন কর্মকর্তাদের নজরে আসে।
লাঠিটিলার ফরেস্টার সালাহ উদ্দিন এলজিইডির উপজেলা কার্যালয়ের প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়ে জানান, এ বিষয়ে বন বিভাগের কোনো পরামর্শ বা অনুমতি চাওয়া হয়নি। চিঠিতে অবিলম্বে নির্মাণকাজ বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।
জুড়ি উপজেলা রেঞ্জ কর্মকর্তা আলাউদ্দিন ডেইলি স্টারকে জানান, ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বনের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, এ ধরনের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বন বিভাগের মাধ্যমে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে।
এ প্রতিবেদক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখেন সড়ক নির্মাণের জন্য খননকাজ চলছে। এ ছাড়া, সড়কের প্রায় ৩০০ মিটার ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে এবং সড়কের এক জায়গায় ইটের স্তূপ রয়েছে।
কাজের টেন্ডার পাওয়া প্যারাডাইস কনস্ট্রাকশনের মালিক সাইদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।'
রেঞ্জ কর্মকর্তা আলাউদ্দিন জানান, সড়ক নির্মাণ বন্ধ রাখতে ৩ দফা চিঠি দিলেও পাকা সড়ক নির্মাণের কাজ চলছেই। নির্মাণের ছাড়পত্রের বিষয়ে এখনো কোনো লিখিত নির্দেশনা পাননি।
এলজিইডি জুড়ি উপজেলা কার্যালয়ের প্রকৌশলী আব্দুল মতিন ডেইলি স্টারকে জানান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের ডিমান্ড অর্ডার (ডিও) পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে তারা প্রকল্পটি শুরু করেছেন।
তিনি আরও বলেন, 'বন বিভাগের হস্তক্ষেপে কাজ বন্ধ হওয়ার পর আমি মন্ত্রীকে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেছেন, "আমি সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলব, যাতে আবার নির্মাণকাজ ব্যাহত না হয়।"'
এলজিইডি মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আজিম উদ্দিন সরদার আব্দুল মতিনের দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, 'বন বিভাগের আপত্তির পর উপজেলা প্রকৌশলী পরিবেশ মন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। মন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সড়কের কাজ শুরু হয়েছে।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর নির্দেশে সংরক্ষিত বনের ভেতর সড়ক তৈরি করা হচ্ছে। এতে লাঠিটিলা বন, এর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হবে। আনুমানিক আড়াই হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৫০ হাজার পুরনো সেগুন গাছ সমৃদ্ধ বাগানটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রের আইন, নীতিমালা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত— কোনো কিছুরই কি কোনো মূল্য নেই এলজিইডির কাছে?'
তবে এ বিষয়ে জানতে বার বার চেষ্টা করেও বন ও পরিবেশ মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি এ প্রতিবেদক।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা ডেইলি স্টার বলেন, 'সংরক্ষিত বনের ভেতরে কাঁচা সড়ক পাকাকরণ কার্যক্রমসহ বন বিরুদ্ধ সকল কার্যক্রম বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'জুড়ি ফরেস্ট রেঞ্জের অন্তর্গত লাঠিটিলা বন পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্টের (পিএইচআরএফ) একটি অংশ। প্রাকৃতিক মিশ্র চিরসবুজ এ বনের আয়তন ৫ হাজার ৬৩১ একর। ১৯২০ সালের ২১ এপ্রিল সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে এ বনকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। এ বনাঞ্চলে ২০৯ প্রজাতির প্রাণী এবং ৬০৩ ধরনের উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। এ বন পরিবেশগতভাবে অরক্ষিত ইন্দো-বার্মা জীব-বৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ এবং দেশের ৬টি আন্তঃসীমান্ত সংরক্ষিত বনের একটি। সম্প্রতি সংরক্ষিত বনে এলজিইডি সড়ক পাকাকরণের কাজ শুরু করেছে। সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে জুড়ি উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের লাঠিটিলা এলাকার লাঠিছড়া থেকে লালছড়া হয়ে রুপাছড়া পর্যন্ত ১ কিলোমিটার পর্যন্ত কাঁচা সড়ক পাকাকরণের কাজ শুরু করেছে এলজিইডি।'
বেলা'র নোটিশে বলা হয়েছে, সংরক্ষিত বনে এ ধরনের রাস্তা নির্মাণ করা হলে বনের অনেক পুরনো সেগুন গাছ রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে। বনের ভেতর দিয়ে যানবাহন চলাচলের কারণে বন্যপ্রাণী মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে, বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হবে, বনভূমি ও জীব-বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংরক্ষিত বনের মধ্যে এরূপ রাস্তা সেগুন গাছ চুরি দ্ব্যর্থহীনভাবে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে।
Comments