বিশ্ব হাতি দিবস

জীবন সংকটে হাতি

নির্বিচারে হত্যার কারণে দেশে বন্য হাতিদের জীবনধারণের বিষয়টি গুরুতর হুমকির মুখে পড়েছে। সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিরক্ষামূলক নীতিমালা না থাকায় হাতির বসবাসের উপযোগী ভূমির পরিমাণ ক্রমশ কমে আসছে।

বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল চট্টগ্রাম বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০১ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত মোট ১২০টি হাতি বিভিন্ন কারণে মারা গেছে। কিছু হাতিকে সরাসরি গুলি করে মারা হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে অন্তত ১২টি হাতিকে চোরাশিকারিরা গুলি করে হত্যা করেছে এবং এ ঘটনাগুলো ঘটেছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে।

কমতে থাকা হাতি সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে সরকার ২০১৮ সালে ছয়টি লক্ষ্যসহ ১০ বছরব্যাপী 'বাংলাদেশ হাতি সংরক্ষণ অ্যাকশন প্ল্যান (বিইসিএপি)' তৈরি করে।

বনের ভেতরে তৈরি একটি ইটভাটা। ছবি: সংগৃহীত

দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বন অধিদপ্তরের তৈরি বিইসিএপির কোনো লক্ষ্যই এখনও পূরণ হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে হাতিদের প্রতি হুমকি আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।

লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত ও চোরাশিকার কমিয়ে আনা, তাদের বসবাসের জায়গার সংরক্ষণ এবং হাতি সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণা করা ও এ সংক্রান্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করা।

২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) এক সমীক্ষায় জানা গেছে কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং শেরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ২৪৮টি এশিয়ান হাতির বসবাস। এই সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল ১২টি চিহ্নিত করিডর, যেগুলোর ওপর দিয়ে হাতির পাল খাদ্যের খোজে এক বন থেকে অন্য বনে যাতায়াত করে।

বাংলাদেশে যে প্রজাতির হাতি আছে সেটিই এশিয়ান হাতি। এই প্রজাতিটিকে আইইউসিএন বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। কেননা চোরাশিকারের পাশাপাশি বন ও পাহাড়ের মধ্যে অবকাঠামো তৈরি করায় তাদের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে রয়েছে।

প্রখ্যাত প্রকৃতিবিদ ও জীববিজ্ঞানী মনিরুল এইচ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি বছর যে পরিমাণ হাতি মারা যাচ্ছে, তা আশংকাজনক।'

তিনি এ ব্যাপারে শিগগির উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৯০টি হাতি সরাসরি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো নিয়মিত চলতে থাকলেও বন বিভাগ এখনও কোনো অপরাধীকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২ এর আওতায় কারাগারে নিতে পারেনি।

এই আইনে হাতি হত্যা একটি জামিন অযোগ্য অপরাধ এবং এই অপরাধে দণ্ডিতদের ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। এ ছাড়াও, দণ্ডিতদের সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানাও করা হতে পারে।

করিডরগুলো হুমকির মুখে

গত তিন বছরে বড় অবকাঠামো ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প নির্মাণের কারণে কক্সবাজারের ১২টি স্বীকৃত করিডোরের মধ্যে তিনটি বন্ধ হয়ে গেছে।

চট্টগ্রামের দোহাজারি ও কক্সবাজারের ঘুমধুমের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কারণে চুনতি-ফাসিয়াখালি-মেধাকচ্ছপিয়া করিডরটিও হুমকির মুখে আছে বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।

বাকি করিডরগুলো অবৈধ অনুপ্রবেশ, ইটের ভাটা স্থাপন, বাগান করা ও সংরক্ষিত বনের ভেতরে মাছ ধরার কার্যক্রমের কারণে হুমকির মুখে পড়ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান আরও বলেন, 'হাতির আবাসস্থলগুলোকে আবারও গড়ে তুলতে হবে। তাদের ঝুঁকি মুক্ত চলাচল নিশ্চিত করার জন্য করিডরগুলোকে সুরক্ষিত করতে হবে।'

'আমাদেরকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণ জনগণের মাঝেও সচেতনতা তৈরি করতে হবে', যোগ করেন মনিরুল।

আইইউসিএনের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন জানান, সরকার এই বিষয়টিকে জাতীয় প্রাধান্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করা পর্যন্ত হাতিদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করা যাবে না এবং তাদেরকে সুরক্ষাও দেওয়া যাবে না।

তিনি বলেন, '১২টি করিডরের মধ্যে তিনটি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু করিডর আছে যেগুলো বেসরকারি জমির ওপর দিয়ে গেছে। আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে এসব ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় হাতিরা নিরাপদ থাকে।'

প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, তারা হাতিদের ব্যবহৃত আরও করিডর চিহ্নিত করার জন্য একটি সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা পরিচালনা করছেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিইসিএপির আওতায় গঠিত এলিফ্যান্ট রেসপন্স দলগুলো শুরুতে ভাল কাজ করছিল। তবে তহবিলের অভাবে আমরা দলের সদস্যদের জন্য সম্মানীর ব্যবস্থা করতে পারিনি। আমি সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি সমন্বিতভাবে কাজ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে।'

আমীর জানান, তারা করিডরগুলো পুনঃ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত নিরসনের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন।

'কিছু করিডর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ওপর। এ কারণে আমরা সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছি যাতে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি কিনে নিয়ে হাতিদের নিরাপদ চলাফেরা নিশ্চিত করা যায়,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'প্রকল্পটি তিনটি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হবে। যদি মন্ত্রণালয় এর অনুমোদন দেয়, তাহলে আমরা বিইসিএপিতে বর্ণিত বেশ কিছু কার্য ধারার বাস্তবায়ন করতে পারবো।'

 

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago