‘সিলেটের প্রতি অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই দেখছি না’
সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। উদ্বেগ, ভয়, ক্রোধ আর হতাশার মধ্যে কাটছে প্রতিটি মুহূর্ত। সিলেটের কুমারপাড়ায় আমাদের বাড়ির বাইরে পানি বাড়তে শুরু করেছে। অথচ, শহরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় আমাদের এলাকাটি তুলনামূলক উঁচু জায়গায়। তারপরও এই ধরনের ঘটনা আমার জন্য একেবারে নতুন নয়।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক শাহজালাল উপশহরের বাসিন্দা। ওই এলাকায় ২ দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। আমার ওই শিক্ষক দেখান, কীভাবে তিনি মোমবাতির আলোতে পরীক্ষার খাতা দেখছেন। এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো বন্যার কবলে পড়েছে এই উপশহরটি।
আমার অধিকাংশ বন্ধু হয় তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে চলে গেছে, অথবা কোমর পানিতে কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। পাওয়ার গ্রিড স্টেশনের মধ্যেও পৌঁছে গেছে বন্যার পানি।
আজ শনিবার সকালে শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা জিন্দাবাজার প্লাবিত হয়েছে। মানুষের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে, ভেসে গেছে অনেক কিছু। সুনামগঞ্জের মানুষের সঙ্গে তাদের সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
এমন পরিস্থিতির কারণে গতকাল আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে এসএসসি পরীক্ষাও। করোনা মহামারির কারণে দেশের শিক্ষার ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। নিঃসন্দেহে এই বন্যা পরিস্থিতিও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
শেষ মুহূর্তে এসএসসি পরীক্ষা বাতিলের খবরে শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা ন্যায়সঙ্গত। অনেকের মতে শুধু সিলেট বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত করা উচিত ছিল।
সিলেটের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মাখা গোঁজার জায়গা নেই, তাদের ঘরে বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এরপরও কি তাদের বর্তমান অবস্থা বুঝতে কষ্ট হবে?
কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের মানুষ যখন জীবন বাঁচাতে মরিয়া, তখন যদি দেশের বাকি বিভাগগুলোতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে বসে, তাহলে ওই শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে সেটা কি অনুধাবন করা খুব কঠিন?
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সিলেটে। আমি দেখেছি, এই শহরের জন্য সব সময় মানুষ ভালোবাসা দেখায়। তবে, যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার সময় আসে তখন যা দেখা যায় সেটাকে অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।
যদিও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেনাবাহিনী তাদের নৌকা ব্যবহার করে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করবে। বিভিন্ন সংস্থা খাদ্য, পানীয় ও চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসছে ও তহবিল সংগ্রহ করছে।
কিন্তু, সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। হাজারো মানুষ আটকে পড়েছেন এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্মুক্ত আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছেন।
এ ধরনের পরিস্থিতিতেও যেখানে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় না, সেখানে কি কোনো আশার আলো দেখা যায়? একমাত্র সহায়তা হিসেবে যা করা হচ্ছে তা হলো— মানুষজনকে তাদের বাড়িঘর, জিনিসপত্র, অনেকের সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ ফেলে চলে যেত বলা হচ্ছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে বলা হচ্ছে।
আমাদের শেখানো হয়, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাহলে বর্ষায় ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেট যে বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে সে সম্পর্কে আগে থেকে জানা সত্ত্বেও আমরা কেন সতর্ক হলাম না?
সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলে এই অঞ্চল ডুবে গেছে। আমরা অতীতে ভয়াবহ বন্যা দেখেছি, কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান দেখিনি। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হলে জোড়াতালি দিয়ে সময়টা শুধু পার করা হয়। তারপর আর কোনো খবর থাকে না। দুর্দশায় পড়েন শুধু সাধারণ মানুষ। তারা হারায় তাদের প্রিয়জন, তাদের সম্পদ।
সবমিলিয়ে, কোনো আশার আলো না থাকলেও সিলেটের মানুষ স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাঁচার লড়াইয়ে ব্যস্ত।
ফায়েজা হুমাইরা মীম: সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতক শিক্ষার্থী।
অনুবাদ করেছেন তাফহিমা জাহান
Comments