নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি, হাওরে বন্যার আশঙ্কা

গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জের নদ-নদীতে ১ দশমিক ৩ মিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার মাত্র শূন্য দশমিক ২২ মিটার নিচে দিয়ে, জাদুকাটা শূন্য দশমিক ৮৬ মিটার ও পুরাতন সুরমা ২ দশমিক ৪৮ মিটার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গত শনিবার সকালে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় নজরখালি বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি ঢুকে পড়ছে। ছবি: সংগৃহীত

গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জের নদ-নদীতে ১ দশমিক ৩ মিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার মাত্র শূন্য দশমিক ২২ মিটার নিচে দিয়ে, জাদুকাটা শূন্য দশমিক ৮৬ মিটার ও পুরাতন সুরমা ২ দশমিক ৪৮ মিটার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সোমবার সকালে সুরমার পানি বিপৎসীমার ১ দশমিক ০৯ মিটার নিচে, জাদুকাটা ১ দশমিক ৮৪ মিটার ও পুরাতন সুরমা ২ দশমিক ৬৯ মিটার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে ব্যাপক বর্ষণের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে গত শুক্রবার রাত থেকেই সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। সোমবার পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিল বলে খবর পাওয়া গেছে।

এ অবস্থায় পানি বাড়তে থাকায় ধান কাটার এখনো সপ্তাহ দুয়েক বাকি থাকতেই পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

নদীর পানি বাড়তে থাকলে বাঁধ ভেঙে ফসলের ক্ষতি হতে পারে বলে পাউবো ও জেলা কৃষি কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে এ বছর ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। পানি বাড়তে থাকায় হাওরাঞ্চলের অনেক কৃষক ইতোমধ্যে আধাপাকা ধান কাটা শুরু করেছেন।

এদিকে হাওর রক্ষা বাঁধ টিকিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি কৃষকরাও স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। তবে বাঁধের কাজ নিম্নমানের হওয়ায় কৃষকরা বেশি শঙ্কিত হচ্ছেন।

নদীর পানির চাপে বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি প্রবেশ করায় প্রায় ২৫ হেক্টর জমির বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

সোমবার সকালে এক জরুরি প্রতিবেদনে পাউবো বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়, আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এর ফলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাবে।

তবে এ প্রতিবেদনে আকস্মিক বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানানো হয়।

আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা না থাকলেও, গত শনিবার সকালে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালি বাঁধ ভেঙে প্রায় ২০০ হেক্টর বোরো আবাদ করা জমি প্লাবিত হয়। একইসঙ্গে গতকাল রোববার রাত থেকে সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার হাওরাঞ্চলে কয়েকশত হেক্টর কৃষিজমি প্লাবিত হয়েছে।

পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীর পানি খুব দ্রুত বাড়ছে আর এভাবে বাড়তে থাকলে মাটির বাঁধ ভেঙে ফসলের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। তাই বাঁধ নির্মাণ সংশ্লিষ্টসহ স্থানীয়দের নিয়ে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।'

সোমবার বিকেলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে সার্বিক পরিস্থিতিতে বাঁধ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সভা শেষে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে সবাইকে আগামী ২৪ ঘণ্টা সতর্ক থাকার অনুরোধ জানান।

২০১৭ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া মুষলধারে বৃষ্টি এবং পরবর্তীতে পাহাড়ি ঢলে এপ্রিল শুরুতে হাওরাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছিল।

সে বছর বন্যায় এই সবকয়টি জেলার ফসল তলিয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃষকরা।

সে বছর বন্যায় বোরো ধান নষ্ট হওয়ায় দেশেও ধানের সংকট দেখা দেয়।

এবারো ২০১৭ সালের মতো বন্যা দেখা দিতে পারে বলে কৃষকরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের কৃষক সাজিদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সে বছরের মতো বন্যা হলে আমরা সর্বস্ব হারাব। গত ২ বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবার আবাদও বেশি করেছি।'

২০১৭ সালের বন্যায় হাওরাঞ্চল তলিয়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার পর ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয় সরকার। তখন বাঁধ নির্মাণের ঠিকাদার এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গুলোর বিরুদ্ধে পৃথক মামলা হয়।

এরপরই সরকার বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় প্রশাসনকে যুক্ত করে 'কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা ২০১৭' ঘোষণা করে। এ নীতিমালা অনুযায়ী হাওরের বাঁধের কাজ আর কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে না দেওয়ার নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করে সবকয়টি বাঁধের আশেপাশের জমির মালিক বা কৃষকদের মাধ্যমে পিআইসি গঠন করে তাদের মাধ্যমে কাজ করানোর জন্য বলা হয়েছে।

এ বছর সুনামগঞ্জ জেলায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৪টি প্রকল্পের অধীনে ৫২০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেছে ৭২৪টি পিআইসি।

তবে এবারও বাঁধ নির্মাণকাজে ব্যাপক দুর্নীতি, গড়িমসি, অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজের অভিযোগ করেছেন কৃষক ও সংশ্লিষ্ট অধিকার সংগঠনের নেতারা।

এবার ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি গঠনের শেষ তারিখ থাকলেও বেশিরভাগ পিআইসি গঠন হয়েছে সময়ের অনেক পরে। কাজও শুরু করতে অনেক দেরি হয়েছে এবং শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে নিম্নমানের কাজ করা হয়েছে বলে অভিযোগ প্রায় সবকয়টি পিআইসির বিরুদ্ধে।

হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সালেহীন চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের নামে যা হয়েছে তা চরম দুর্নীতি। বেশিরভাগ কাজই খুবই নিম্নমানের হয়েছে। এগুলো ঢল সামলাতে পারবে না। এছাড়াও প্রয়োজনীয় জায়গায় বাঁধ নির্মাণ না করে কিছু ব্যাক্তিবিশেষকে সুবিধা দিতে প্রচুর অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।'

প্রয়োজনীয় স্থানে বাঁধ নির্মাণ না করার উদাহরণ হিসেবে তিনি গত শনিবারের ঢলে ভেঙে যাওয়া টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের নজরখালি বাঁধের কথা উল্লেখ করেন।

এ বিষয়ে পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুদ্দোহা জানান, কৃষকদের দাবির মুখে এই বাঁধে কিছুটা সংস্কার কাজ করা হয়েছিল। তবে বাঁধটি মুল ৭২৪টি স্কিমের মধ্যে ছিল না।

তিনি বলেন, 'সবকয়টি বাঁধই কাজ শেষে মূল্যায়ন করা হয়। আর এর মধ্যে কোনো অনিয়ম থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করা যায়নি। কোন জায়গায় নিয়ম ভেঙে বাঁধের গোঁড়া থেকে মাটি নেয়া হয়েছে। এসব হাওরবাসীর প্রতি চরম অবহেলার নজির। যাদের অবহেলায় বাঁধ নিয়মানুযায়ী হয়নি, আরা তাদের শাস্তি দাবি করছি এবং এর ফলে হাওরের ফসলের ক্ষতি হলে এর দায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।'

বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নজরখালি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ও বংশীকুন্ডা উত্তর দুটি ইউনিয়নের ব্যাপক ফসলি জমি বন্যার আশঙ্কায় পড়েছে। আমরা ইতোমধ্যে নিজেদের উদ্যোগে মুক্তারখলা বাঁধ নির্মাণ কাজ করছি, যেন ঢল আসলে ফসল যতটা সম্ভব রক্ষা পেতে পারে।'

যোগাযোগ করা হলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নজরখালি বাঁধ ভাঙায় অন্তত ২৫ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এবার হাওরে বোরো ধানের চাষ লক্ষ্যমাত্রার থেকেও বেশি হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ফলনও ভালো হয়েছে। বন্যায় ফসলহানি না হলে বাম্পার ফলন হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

17h ago