স্কুলে জাতীয় পাঠ্যক্রমের যত সমস্যা

ছবি: প্রবীর দাশ

এক গ্রীষ্মের বিকেলে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাসে এসে কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় ধাঁধার মুখে যেন পড়েছিলেন আমাদের শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক। ওই ক্লাসে তার আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ঋতুস্রাব। জড়তা বা দ্বিধা নিয়ে তিনি মিনিট দশেক কথা বললেন।

আমি যদি সেই অস্বস্তিকর মিনিটগুলোকে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অনুমোদিত সংস্করণ বলার সাহস করি, তাহলে সেখানে পিরিয়ডস, ঋতুস্রাব বা স্যানিটারি প্যাডের মতো শব্দগুলো যেন পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় শেষ করার পরে প্রবল আগ্রহ নিয়ে শুরু করলেন হ্যান্ডবল মাঠের পরিমাপ শেখাতে। অথচ, আমরা কখনো এই খেলাটি খেলিনি।

যদি তার শেখানোর প্রচেষ্টার বিষয়টি এড়িয়েও যাই, যৌন শিক্ষার যে সিলেবাস আমাদের উচ্চ বিদ্যালয় পর্যায়ে রয়েছে তা যেন ডুবে যাওয়া একটি জাহাজের মাস্তুলের চূড়া মাত্র।

আমাদের পাঠ্যক্রমের ধরণের কারণে শিক্ষার্থীরা ব্যবসায়ী শিক্ষা বা কলা বিভাগের চেয়ে বিজ্ঞান বিভাগটা বেছে নেওয়াটাই শ্রেয় বলে মনে করে। বেশির ভাগ স্কুলে ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করে দেয় এবং তুলনামূলক খারাপ ফলাফল করতে তাদের জোর করেই ব্যবসায়ী শিক্ষা বা কলা বিভাগে ভর্তি করে। শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে কি হতে চায় সেই ব্যাপারে জানার কোনো চিন্তা তাদের থাকে না। শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যের এখানেই শেষ নয়। এমন একটি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে, কেবলমাত্র প্রতিভাবানরাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। ফলস্বরূপ, অভিভাবকরা আশা করেন যে তাদের সন্তানের আগ্রহ থাক বা না থাক, তারা বিজ্ঞান বিভাগেই পড়বে।

বুয়েটের স্নাতক শিক্ষার্থী অনিন্দ্য আলম বলেন, 'প্রচলিত আছে যে, বিজ্ঞানের চেয়ে বাণিজ্য বিভাগে পড়া সহজ। এটা মোটেও সত্য নয়। কম গ্রেডের শিক্ষার্থীদের এমন বিষয় পড়তে হয় যেটা আসলে তাদের কাছে বিজ্ঞানের চেয়েও অনেক বেশি কঠিন হতে পারে।'

বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কলেজ শাখার আগে ব্যবসায়ী শিক্ষা বা কলা বিভাগই নেই। একজন শিক্ষার্থীতে যদি নবম শ্রেণিতে বাধ্য হয়ে বিজ্ঞান বিভাগ নিতে হয়, তাহলে কলেজে গিয়ে তার জন্য অন্য বিভাগে পড়া কঠিন হয়ে যায়।

এর বিপরীত দিক ভাবলে, ব্যবসায়ী শিক্ষা বা কলা বিভাগ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়াশুনা করা বড় অংশের শিক্ষার্থীকে ব্যবসায়ী শিক্ষা বা কলা বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হতে হয়। যা আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অদক্ষতাই প্রমাণ করে।

আমাদের উচ্চ বিদ্যালয় স্তরে পাঠ্যক্রমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যর্থতা হলো, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা চিহ্নিত করা ও অল্প বয়স থেকেই এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করার বিষয়ে অপর্যাপ্ততা।

বুয়েট শিক্ষার্থী তাসমিন খান বলেন, 'একজন শিক্ষার্থীর পুরো একাডেমিক জীবনে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত বিষয় হচ্ছে তার মানসিক স্বাস্থ্য। এর জন্য কিছু তাত্ত্বিক পাঠ বইয়ে পাওয়া যায়। তবে, পেশাদার কেউ এ বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করেন না।'

আমাদের সমাজ মানসিক স্বাস্থ্যকে সুস্থতার একটি অংশ হিসেবে মনেই করে না। তবে উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো যোগ করা হলে আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজেদের আবেগ দায়িত্বশীলভাবে পরিচালনা করতে পারবে এবং এই প্রক্রিয়ায় বড় পরিসরে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সবার সচেতনতা আসবে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের পাঠ্যক্রমের সবচেয়ে বড় ত্রুটিগুলো  পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতের মতো বিষয়ে রয়েছে। গণিতের বোর্ড অনুমোদিত বইগুলো প্রায়োগিক দিকে নয়, বরং অনুশীলনে অত্যধিক জোড় দেয়। সেখানে গাণিতিক তত্ত্বে ব্যাখ্যারও কমতি রয়েছে। একই অবস্থা রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানেরও।

অনিন্দ্য আলম বলেন, 'বোর্ড অনুমোদিত পদার্থবিজ্ঞানের বইগুলোতে বিশদ ব্যাখ্যার কমতি আছে। সেগুলো বোঝার জন্য শিক্ষার্থীদের কলেজ শাখার বই কিংবা প্রাইভেট শিক্ষকদের শরণাপন্ন হতে হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশে রসায়ন পড়ানোর সময় প্রায়োগিক দিকে মোটেই নজর দেওয়া হয় নয়। বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীদের এগুলো শুধুই মুখস্থ করতে হয়।'

কিছুই না বুঝে এমসিকিউ সঠিকভাবে পূরণের জন্য অপ্রাসঙ্গিক প্রচুর তথ্য শিক্ষার্থীদের মুখস্থ রাখতে হয়।

এই সমস্যা বাংলা ও ইংরেজির মতো বিষয়েও রয়েছে। এনসিটিবি অনুমোদিত বাংলা বই যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলেও সেখান থেকে পরীক্ষায় প্রশ্নের ধারা ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, এমসিকিউয়ের বৈতরণী পার হওয়া ব্যাপকভাবে নির্ভর করে গল্প বা কবিতা থেকে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য মুখস্থ রাখার ওপর। এতে করে আসলে পরীক্ষার্থী পাঠ্যটি অনুধাবন করেছে কি না তার মূল্যায়ন হয় না।

বোর্ড অনুমোদিত ইংলিশ ফর টুডে ইংরেজি বইটি নিয়ে রীতিমতো উপহাস করা হয়। কারণ হচ্ছে, এর জন্য নির্বাচিত প্রবন্ধ ও কবিতা, পাঠকদের ভাষাগত ক্ষমতা বোঝার ক্ষেত্রে নিরর্থকতা এবং ফলস্বরূপ ইংরেজিতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বিকাশে ব্যর্থতা। পরীক্ষায় ইংরেজি শব্দভাণ্ডার বা কোনো বক্তৃতা বিশ্লেষণের মতো দিক অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যেটা কিনা ভাষা শেখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলাফল হচ্ছে, শিক্ষার্থীর উদ্বেগ, অস্বস্তি ও ইংরেজিতে অদক্ষতা।

কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা, ক্যারিয়ার শিক্ষা ও কৃষি শিক্ষার মতো বিষয়গুলো ব্যবহারিক বিষয়ে শিক্ষার্থীর দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করার জন্যই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যদিও শিক্ষার্থীরা এই বিষয়গুলোকে 'বিরক্তিকর' ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। আমাদের কোচিং ক্লাসের সংস্কৃতি ইতোমধ্যে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত এই কোর্সগুলোকে পুঁজি করার একটি উপায় তৈরি করেছে।

উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এমন বিষয়ে টিউশন নেওয়ার কথা ভাবছে, যা কিনা তাদের ক্যারিয়ারের গড়ে দেবে বলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সত্যি বলতে, এটা আমাদের শিক্ষার সমষ্টিগত দিক বুঝতে না পারার একটি অন্ধকার চিত্র। একইসঙ্গে, এটা এই বিষয়গুলোতে পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু তৈরির ক্ষেত্রে এনসিটিবির ত্রুটিও তুলে ধরে।

এনসিটিবি ২০২৫ সালের মধ্যে একটি নতুন পাঠ্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করছে, যেখানে তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিবর্তে দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হবে এবং নবম থেকে দশম শ্রেণিতে আর বিভাগ থাকবে না। মন্ত্রণালয় দক্ষতার এমন ১০টি বিষয় চিহ্নিত করেছে, যেগুলো দ্বাদশ শ্রেণি পাস করার সময় শিক্ষার্থীদের আয়ত্ত করা উচিত বলে তারা মনে করছে। প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে ক্লাস পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ এবং পাবলিক পরীক্ষার ভিত্তিতে বাকি ৫০ শতাংশ নম্বর পাবে। তবে জীবন ও জীবিকা, ধর্ম, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, কলা ও সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ের নম্বর দেওয়া হবে সম্পূর্ণভাবে স্কুল পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হাবিব উল্লাহর মতো একাধিক স্কুল শিক্ষকের মতে এই নতুন পাঠ্যক্রমের ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।

হাবিব বলেন, '১০টি মূল বিষয়ের মধ্যে ৫টির মূল্যায়ন পুরোপুরি ক্লাস পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়গুলোর প্রতি নজর কম থাকবে, আর বাকি ৫টি বিষয় পড়ার প্রতি আমরা বেশি জোর দেব। কারণ, সেগুলোর ওপর পাবলিক পরীক্ষা হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'ফলস্বরূপ, গ্রেডিং সিস্টেমের কারণে এই বিষয়গুলো অবাস্তব বলে প্রমাণিত হতে পারে। যদি গ্রেডিং স্কুলের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে সেখানে দুর্নীতির সুযোগও তৈরি হকে পারে।'

মন্ত্রণালয় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতেও একই কৌশল বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে, যেখানে ৩০ শতাংশ ক্লাস পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে এবং ৭০ শতাংশ পাবলিক পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে হবে।

আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রমের উন্নয়ন একটি বিস্তৃত ও জটিল প্রক্রিয়া। যদি এনসিটিবি সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতন হয় এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনরায় সাজাতে পারে তাহলেই এর সমাধান হতে পারে। কোর্সের বিষয়বস্তু সংশোধন, নতুন করে বই লেখা, পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে গিয়ে নতুন নতুন বিষয় শেখার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সর্বোপরি এর সাফল্য নির্ভর করবে স্পষ্টতই সঠিকভাবে বাস্তবায়নের উপর। দুর্ভাগ্যবশত, যখন প্রস্তাবিত বিষয় বাস্তবায়নের কথা আসে, তখন এনসিটিবির রেকর্ড সুখকর কোনো বার্তা দেয় না।

Comments

The Daily Star  | English

Cyber protection ordinance: Draft fails to shake off ghosts of the past

The newly approved draft Cyber Protection Ordinance retains many of the clauses of its predecessors that drew flak from across the world for stifling freedom of expression.

8h ago