যথেষ্ট বেতন পান না প্রাথমিকের শিক্ষক
একজন শিক্ষকের কাজ মোটেই সহজ নয়। তিনি যে শুধু শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেন তাই নয়, তিনি তাদের শেখান এই বিশ্ব সম্পর্কেও। তিনি শেখান সমাজ, রাষ্ট্র তথা পৃথিবীতে চলতে গেলে কোন কাজ করা উচিত আর কোন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
প্রত্যাশা করা হয়, একজন শিক্ষক তার নিজের সময় থেকে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য অনুশীলনের চার্ট তৈরি করবেন, তাদের প্রত্যাশিত অগ্রগতি হচ্ছে কি না সে বিষয়ে নজর রাখবেন, এমনকি যেকোনো সময় যেন শিক্ষার্থীরা তাদের সহযোগিতা নিতে পারে সেজন্য প্রস্তুত থাকবেন।
এত এত প্রত্যাশা আর কাজের চাপের মাঝে যাদের রাখছি, সেই শিক্ষকদের আমরা কতটা দিচ্ছি?
ঠাকুরগাঁওয়ের কেবিএম হাই স্কুলের ইংরেজি ও সিভিক শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, 'শিক্ষকতা মহান পেশা জেনে এর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। তাই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছি। ২০০৪ সাল থেকে নিজেকে উজাড় করে দেই শিক্ষার্থীদের জন্য। এই পেশার প্রতি ভালোবাসাটা আছে জন্যই পারছি। নইলে যেটুকু টাকা বেতন পাই, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব না।'
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষক খুবই কম বেতন পান। এ বছরের শুরুতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ১৩তম গ্রেডে বেতন পাবেন। এই গ্রেডে বেতন সীমা ১১ হাজার টাকা থেকে ২৬ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। একই আদেশে বলা হয়েছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেতন পাবেন ১১তম গ্রেডে।
বেসরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের আরও কম বা মান্থলি পে অর্ডার (এমপিও) সুবিধার আওতায় সরকারি শিক্ষকদের সমান বেতন দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্ডেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, 'বেসরকারি স্কুলের নন-এমপিও শিক্ষকদের বেতন নির্ভর করে স্কুলে কত টাকা বেতন আদায় করা সম্ভব হয় তার ওপর। বেতনের টাকা থেকে স্কুল ভবনের ভাড়া ও যাবতীয় খরচ মেটানোর পর যা থাকে সেখান থেকে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। করোনা মহামারির মধ্যে যখন বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাননি, তখন স্কুলগুলোর আয় কমে যায়। ফলে, বিপদে পরেন শিক্ষকরা। তাদের বেতন বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে পেশা বদল করেছেন, আবার অনেকের মাসের পর মাস বেতন ছাড়াই অন্য কোনোভাবে আয় করে চলতে হয়েছে।'
যদি আমরা ধরেও নেই যে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ের সব শিক্ষক সরকার ঘোষিত বেতন পান, সেখানেও প্রশ্ন ওঠে যে—এই টাকাটা কি যথেষ্ট?
গত ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, যেটা বেড়ে এপ্রিলে হয়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে, সেইসঙ্গে বেড়ে চলেছে জীবনযাপনের ব্যয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার একজন শিক্ষক একটি সংবাদপত্রে তার আর্টিকেলে লিখেছেন, 'একটি পরিবার চালানোর জন্য ৫০ হাজার টাকাও যথেষ্ট না'। অথচ, বেশিরভাগ শিক্ষক এরচেয়ে অনেক কম টাকা বেতন পান।
জীবনধারা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁয়ের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, 'যা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালানো যায় না। সংসার চালাতে অন্যান্য উপায়ে আয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। আমি নিজেও যেমন একটা ব্যবসা করি। মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন ফসল কিনে রাখি, কয়েক মাস পরে সেগুলো বিক্রি করি। সেইসঙ্গে মেইন রোডের পাশে তেলের পাম্পের ভেতরে আমার একটি মুদির দোকান আছে। সব মিলিয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে পারছি।'
দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। তাকে অনুরোধ করা হয় ওই স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দেওয়ার জন্য। তিনি রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রধান শিক্ষক জানান, শিক্ষকদের সবাই বলবেন যে তারা খুবই কম বেতন পান। আর এই বিষয়টি স্কুলের জন্য সম্মানজনক হবে না।
ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, 'এমপিও ও নন-এমপিও শিক্ষকদের সবাই কম বেতন পান। তবে, রাজস্ব খাত থেকে যারা বেতন পান তাদের অন্তত এই নিশ্চয়তাটুকু আছে যে মাস শেষে তারা বেতন পাবেন। কিন্তু এর বিপরীত চিত্র বেসরকারি স্কুলগুলোর সেই শিক্ষকদের যারা রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান না। করোনার মধ্যেই প্রায় ২০ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে শিক্ষকের সংখ্যাও প্রায় ১০ লাখ থেকে কমে হয়ে গেছে ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ।'
বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, 'বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি শিক্ষক এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে প্রচণ্ড পরিমাণ বৈষম্য রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ২০০৪ সাল থেকে উৎসব ভাতা পাচ্ছেন ২৫ শতাংশ। এটি আর বাড়ানো হয়নি। অথচ, সরকারি অন্য সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী উৎসব ভাতা পান অন্তত ৫০ শতাংশ। এ ছাড়াও, তারা বাসা ভাড়া, স্বাস্থ্য সুবিধাসহ আরও অনেক বিষয়ে যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা পান তা আমরা পাই না।'
২০১৬ সালে স্কুলের শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি যারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করাবে তাদের শাস্তির আওতায় আনার কথাও বলা হয়। দুঃখজনকভাবে, যে দেশে শিক্ষকদের যথেষ্ট পরিমাণ বেতন দেওয়া হয় না এবং তাদের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বাড়তি আয়ের সুযোগও দেওয়া হয় না, সেখানে শিক্ষকদের সুন্দরভাবে জীবন পরিচালনা করা অলীক কল্পনা হতে বাধ্য।
শফিকুল ইসলাম বলেন, 'এত কিছুর পরেও শিক্ষকতা ছাড়তে পারি না। একে তো এর প্রতি ভালো লাগা আছে, তারপর আবার এখন ছেড়ে দিলে চাকরি শেষে যেটুকু সুবিধা পাওয়া কথা আছে সেটাও পাব না।'
এভাবেই আমাদের শিক্ষকরা কম বেতন পেয়েও শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। আর অনেকে অনেক বছর এই পেশায় থেকেও শেষ পর্যন্ত আর টিকতেই পারেননি পেটের দায়ে। অথচ, তারা যে কাজটি করছেন তা আমাদের প্রতিটি পরিবারের, সমাজের তথা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
নজরুল ইসলাম রনি বলেন, 'আমরা যদি শিক্ষকদের তাদের প্রাপ্যটা দিতে না পারি, তাহলে শিক্ষার মান উন্নয়নের আশা করাটা কেবলই বোকামি।'
যখনই আমাদের শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রশ্ন আছে, তখনই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষকদের বিষয়টিও চলে আসে। যদিও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে তাদের সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন খুব বেশি হয় না।
শিক্ষকদের যে পরিমাণ বেতন-ভাতা দেওয়া হয় সেটা দিয়ে তাদের কাছে খুব বেশি কিছু আশা করাও সম্ভব না। এভাবেই যদি আমরা আমাদের শিক্ষকদের কম বেতন দিতে থাকি তাহলে ভবিষ্যতে তার পরিণাম ভোগ করার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। কেননা, এমন একটি সময় আসবে যখন শিক্ষার্থী থাকবে কিন্তু তাদের শেখানোর জন্য শিক্ষক থাকবে না।
সৈয়দা আফরিন তারান্নুম, সহ-সম্পাদক, সাউট, দ্য ডেইলি স্টার
afrin.tarannum@thedailystar.net
Comments