চমেক: চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ও আধিপত্য নিয়ে ছাত্রলীগের কোন্দল
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ কোনো বিচ্ছিন ঘটনা ছিল না। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনটির দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল।
গত শুক্র ও শনিবারে চমেক ছাত্রলীগের দুই পক্ষ—চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী এবং চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
চমেক সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পাসের পাশের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাঁদাবাজি, হাসপাতালে খাবার সরবরাহকারী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ এবং ওষুধপত্র চুরির মতো কর্মকাণ্ডের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে এই বিরোধ দেখা দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ছাত্রনেতাদের অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস হলো চাঁদাবাজি। নেতারা ক্যাম্পাসের কাছে ৩০টি প্রাইভেট ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মতো বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আদায় করে।
একই কথা জানিয়েছেন চমেকের আরেক শিক্ষার্থী। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'ছাত্রলীগ চমেকের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে। ছাত্রলীগের নেতারা হাসপাতালে খাবার সরবরাহ করার জন্য একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তারা মেডিকেলের স্টোর ও ওয়ার্ড থেকে ওষুধ চুরি এবং চমেকের কাছের কয়েকটি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, অ্যাম্বুলেন্স চালক ও কয়েকটি বড় ফার্মেসি থেকে চাঁদাবাজি করেন।'
এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নেতারা নগদ টাকা চাঁদাবাজির জন্য প্রতিদিন বা প্রতি মাসে আসে এমনটা নয়। তাদের অনেক অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা বা স্পন্সর করার জন্য নেতারা আমাদের কাছে আসেন এবং তখন আমাদের অবশ্যই সেটা মেনে নিতে হয়।'
ছাত্রলীগের উভয় পক্ষই নিজেদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও এখন একে অন্যের বিরুদ্ধে এসব অপকর্মের অভিযোগ তুলছে।
যোগাযোগ করা হলে চমেকের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা অভিজিৎ দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চমেকে চাঁদাবাজি এবং সিন্ডিকেট একটি বাস্তবতা। ছাত্রদের একটি অংশ ছাত্রলীগের নামে ছাত্রাবাস, ক্যাম্পাস এবং হাসপাতালে আধিপত্য বিস্তার করে। তারাই সব ধরনের চাঁদাবাজি ও অবৈধ সিন্ডিকেটের পেছনে রয়েছে।'
'তারা কারা?' এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'এসবের পেছনে সাবেক সিটি মেয়রের অনুসারীরা আছে। আমরা ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজদের প্রতিহত করতে গেলে তারা আমাদের ওপর একের পর এক হামলা চালায়। সর্বশেষ হামলাটি ছিল আকিবের ওপর। সে এখন আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে।'
এ প্রসঙ্গে জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী ছাত্রলীগের চমেক শাখার সাধারণ সম্পাদক আল আমিন ইসলাম শিমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন।
যোগাযোগ করা হলে বিএনপির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন জানান, অবৈধ কর্মকাণ্ডকে ঘিরেই বর্তমান সংঘর্ষ চলছে।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের কাছ থেকে ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাই। আমি শুধু ছাত্রদেরই দায়ী করব না। রাজনৈতিক নেতাদেরও দায় আছে, যারা তাদেরকে আশ্রয় দেয়। এ বিষয়ে চমেকের একাডেমিক কাউন্সিলের সতর্ক হওয়া উচিত।'
এ প্রসঙ্গে জানতে চমেকের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেনা আক্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সুস্থ হয়ে উঠছেন আকিব
শনিবারের সংঘর্ষে আহত মাহাদি জে আকিব চমেকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) সুস্থ হয়ে উঠছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সোমবার এক চিকিৎসক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সে আজ (সোমবার) সাড়া দিতে শুরু করেছে।'
এদিকে ছেলের এমন অবস্থার জন্য নোংরা রাজনীতিকে দায়ী করেছেন আকিবের বাবা গোলাম ফারুক মজুমদার।
গতকাল আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, 'আমি চাই আর কারো ছেলে যেন এই পরিণতির মুখোমুখি না হয়। এখন, আমি শুধু তার দ্রুত সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছি এবং তার মুখ থেকে "বাবা" ডাক শোনার অপেক্ষা করছি।'
এদিকে শনিবার রাতে চমেক ছাত্রাবাসে সংঘর্ষের ঘটনায় চকবাজার থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফেরদৌস জাহান জানান, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী ও চমেক ছাত্রলীগ কর্মী মাহমুদুল হাসান গতকাল প্রতিপক্ষের ১৬ জন ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
এর আগে আকিবের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় হওয়া মামলায় সাবেক মেয়র নাসিরের অনুসারী দুই ছাত্রলীগ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমান জানান, ছাত্রলীগ কর্মী তৌফিকুর রহমান বাদী হয়ে ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি করেন।
Comments