করোনাকালে তরুণদের ৬১.২ শতাংশ বিষন্নতায় ভুগছেন: আঁচল ফাউন্ডেশন

করোনাকালে দেশে তরুণদের ৬১ দশমিক ২ শতাংশ বিষন্নতায় ভুগছেন এবং ৩ দশমিক ৭ শতাংশ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে এক জরিপে উঠে এসেছে। বিষন্নতায় ভোগা ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন তারা তাদের বিষন্নতা বা মানসিক অস্থিরতা ভাগ করে নেওয়ার জন্য কাউকেই পাশে পান না।

শনিবার সকালে অনলাইনে ‘করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিপর্যয়; আত্মহননের পথে তরুণ সমাজ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনসহ জরিপ প্রকাশ করে শিক্ষার্থীভিত্তিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশন৷

করোনাকালীন সময়ে তরুণেরা প্রধাণত ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ হারানো, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, একাকী হয়ে যাওয়া, অনাগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপ, আর্থিক সমস্যা, সেশন জট, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি এসব মানসিক চাপজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বলে জরিপে উঠে আসে৷

সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্লে থেরাপিস্ট মোশতাক আহমেদ ইমরান এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

জরিপের তথ্যে, করোনাকালীন সময়ে ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশিরভাগ সময় ব্যয় করছে, যাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী৷ এ সময়ে আগের চেয়ে তাদের মানসিক চাপ বেড়েছে বলেছেন ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ৷

গত মার্চে আঁচল ফাউন্ডেশন করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার হার সংক্রান্ত একটি জরিপ পরিচালিত করে৷ যেখানে দেখা যায়, আত্মহননকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৯ শতাংশই তরুণ। যাদের বয়স ১৮- ৩৫ এর মধ্যে।

ফাউন্ডেশন জানায়, তরুণদের মাঝে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের জুন এর ১-১৫ তারিখ পর্যন্ত ‘’আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা”শীর্ষক একটি জরিপ পরিচালনা করে আঁচল ফাউন্ডেশন। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা, আত্মহত্যার কারণ চিহ্নিতকরণ ও তার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা এবং সবাই যাতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্যোগী হয় সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা।

জরিপে ১৮-৩৫ বছরের ২০২৬ জন অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ ছিল ১৮- ২৫ বছর বয়সী ১৭২০ জন তরুণ-তরুণী। নারীর সংখ্যা ১২৯৩ জন বা ৬৩ দশমিক ৮ শতাংশ ও পুরুষের সংখ্যা ৭৩১ জন বা ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং ট্রান্সজেন্ডার ছিলেন দশমিক ১০ শতাংশ।

গবেষকেরা জানান, প্রয়োজনের বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। জরিপ অনুসারে মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ ২ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করেন। বাকি ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ দুই ঘণ্টার বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটান। তাদের মধ্যে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ দৈনিক ৬ ঘণ্টার বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অতিমাত্রায় ব্যবহার করেন।   

মানসিক বিভিন্ন চাপের ফলে অনেকের মাঝেই আত্মহত্যা করার চিন্তা বা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। জরিপে দেখা যায় তরুণদের ৫০ দশমিক ১ শতাংশই আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করেছেন। এদের মধ্যে করোনাকালীন সময়েই আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছেন ২১.৩ শতাংশ। জরিপের ৯৩.৪ শতাংশ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কথা জানলেও মাত্র ৮.৫ শতাংশ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়েছেন।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘তরুণরাই আগামীর দেশ গড়ার কারিগর। তরুণরা যখন আত্মহত্যাপ্রবণ কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে তা নিশ্চিতভাবেই দেশের জন্য অশনী সংকেত। যারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত শুধুমাত্র তাদের কউন্সেলিং দেয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে না। বরং একজন তরুণ বা তরুণী কেনো আত্মহত্যাপ্রবণ বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে তার কারণ বের করে সমাধান করে সমস্যার মূলোৎপাটন করতে হবে।’

সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘এর সমাধান কেবল একপক্ষের হাতে নেই। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজও রাষ্ট্রকে যুগপৎভাবে কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যক্তির যেমন সচেতন হওয়া জরুরি, তেমনি পরিবারেরও বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে সন্তানকে মানসিক ট্রমার হাত থেকে বাঁচাতে। সমাজেরও দায়িত্ব কেউ যেন নিগৃহীত, বৈষম্যের শিকার না হয় তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। একই সাথে একজন তরুণ তরুণীর সব ধরনের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করে তাকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করতে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকেও।’

সংবাদ সম্মেলনে সাইকোলজিস্ট এবং প্লে থেরাপিস্ট মোস্তাক ইমরান বলেছেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি করোনায় তরুণ তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের ঘুম কম হচ্ছে, বিষণ্ণতা ও হতাশা বাড়ছে, আত্মহত্যার হারও বাড়ছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের ও তাদের পরিবারের মনোসামাজিক সহায়তা বা কাউন্সেলিং সেবা নিশ্চিত করতে হবে।’

সংকট নিরসনে আঁচল ফাউন্ডেশন ১০টি প্রস্তাবনা দেয়। তার মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সচেতনতা বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করা, শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক কাজে উৎসাহ দেওয়া ও তাদের জন্য সেই ধরনের সুযোগ তৈরি করে দেয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইন্টারনেটের অযাচিত ব্যবহারে নিরুৎসাহ করার পাশাপাশি সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার প্রস্তাব দেয়। সেইসঙ্গে সারাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র ও জাতীয় হটলাইন নাম্বার চালু করা যাতে জরুরি ভিত্তিতে যে কেউ ফোন কল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে মেন্টাল ক্রাইসিস সেন্টার তৈরি করা। যে কেউ যেন নামমাত্র মূল্যে মানসিক সেবা নিতে পারে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেলা, উপজেলা বা থানা ভিত্তিক কাউন্সিলর নিয়োগ দেয়া। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের অন্যান্য স্তরের মানুষের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সন্তানদের সাথে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে সন্তান মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে তারা পাশে থাকতে পারেন। একই সাথে সন্তানের প্রতি অযাচিত চাপ তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং. স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো। করোনার এ সময়ে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে কেমন আছে, কেউ বিষন্নতায় ভুগছে কিনা, এ বিষয়ে ফোন কল বা সম্ভব হলে ব্যক্তিগত দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে খোঁজ খবর নেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

5h ago