সব দেশে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে যেতে চাই: নাজমুন নাহার
বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৫০তম দেশ ভ্রমণের ব্যক্তিগত মাইলফলকটি স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন নাজমুন নাহার! তার সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।
বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার আর পৃথিবী দেখার স্বপ্নে কখনো দুর্গম পাহাড়, কখনো বিশাল সমুদ্র, কখনো তুষারে আচ্ছন্ন শহর, কখনো উত্তপ্ত মরুভূমিতে পা রেখেছেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্য আফ্রিকার দ্বীপদেশ সাও টোমে ও প্রিন্সিপে পৌঁছানোর মাধ্যমে ১৫০ দেশে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে গেছেন এই আলোকিত নারী।
অসাধারণ এই কীর্তি গড়ার পর হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকে কথা হচ্ছিল। ঘড়ির কাঁটায় ঢাকার সময় তখন ৭ অক্টোবর ভোররাত ২টা ৪২ মিনিট। সাও টোমেতে তখন রাত ৮টা ৪২ মিনিট।
ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে নাজমুন নাহার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আজ আমার আরেকটা স্বপ্ন পূরণ হলো। আমি ভীষণ আনন্দিত। অনেক কষ্টের পর এই অর্জন। দীর্ঘ ২১ বছর বহু কষ্ট ও সাধনায় ১৫০ দেশে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণের মাইলফলক পূর্ণ হলো। এটা শুধু আমার নয়, এই অর্জন বাংলাদেশের সব মানুষের।'
পৃথিবীর ১৫০ দেশ ঘুরে দেখা এই মানুষ যখন কথা বলতে শুরু করেন তখন মনে হয় দেশটা তিনি চোখের সামনে দেখছেন। যেন তিনি পুরো পৃথিবীর একটি মানচিত্র। গত ১০ জানুয়ারি তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। আফসোস করছিলেন করোনা মহামারি নিয়ে। কারণ, কোথাও যেতে পারছেন না। বলছিলেন, করোনার প্রকোপ কমে গেলেই তিনি আবার বেরিয়ে পড়বেন। বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৫০ তম দেশ ভ্রমণের ব্যক্তিগত মাইলফলক স্পর্শ করবেন। অবশেষে করলেনও।
জুলাইয়ে ফের ভ্রমণের নেশায় বেরিয়ে পড়েছেন এই ভ্রমণকন্যা। বুরুন্ডি, কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, নামিবিয়া ও অ্যাঙ্গোলা ভ্রমণ করে গতকাল আফ্রিকার দ্বীপদেশ সাও টোমে ও প্রিন্সিপে পৌঁছে সেই কীর্তি গড়লেন তিনি।
বাংলাদেশি এই পরিব্রাজক জিম্বাবুয়ে ভ্রমণের মাধ্যমে শততম দেশ পূর্ণ করেছিলেন ২০১৮ সালের ১ জুন। এরপর গত ৩ বছরে তিনি আরও ৫০টি দেশ ঘুরেছেন।
নাজমুনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর। তিনি বলছিলেন, 'আই ওয়াজ বর্ন টু ট্রাভেল।' আসলে ছোটবেলা থেকেই ভ্রমণবিষয়ক বইয়ে ঝোঁক ছিল তার। বই পড়েই তার বিশ্ব ভ্রমণের ইচ্ছে জাগে। তার এই উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন বাবা মোহাম্মদ আমীন।
নাজমুনের দাদা আহমদ উল্লাহ একজন ইসলামিক স্কলার ছিলেন। তিনি ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত আরবের নানা দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। বাবার মুখে শোনা সেসব গল্প মনে গেঁথে গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই দেশের ভ্রমণকাহিনী পড়ে শিহরিত হতেন। বাবা সবসময় তাকে উৎসাহ দিতেন। পৃথিবী ভ্রমণের স্বপ্ন জন্মের পর থেকেই তার ভেতরে লালিত হয়েছিল এভাবে।
দেশের মধ্যে বিভিন্নস্থানে ঘোরাঘুরির পর ভারত ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল তার বিদেশ ঘোরা। ২০০০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হিসেবে ভারতে গিয়েছিলেন তিনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন নাজমুন। ২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে চলে যান সুইডেন। পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করতেন। কখনো ১৭–১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে পয়সা জমাতেন শুধু ভ্রমণের জন্য। কম খরচে থাকতেন পৃথিবীর নানা ট্রাভেলার্স হোস্টেলে। কখনো তাঁবু খাটিয়ে, কখনো বা কোচ সার্ফিংয়ের মাধ্যমে।
নাজমুন নাহার কয়েকটি সংস্থায় চাকরিও করেছিলেন। কিছু টাকা জমলেই বেরিয়ে পড়েন ভ্রমণে। খরচ কমানোর জন্যে বেশিরভাগ সময় সড়ক পথে ভ্রমণ করতেন তিনি। কোথাও যাওয়ার আগে সেই মহাদেশের ম্যাপ ও সেখানকার দর্শনীয় জায়গাগুলোর খোঁজ নিতেন। জানতেন কিভাবে কম খরচে সেখানে পৌঁছানো যায়।
নাজমুন জানান, এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে দিনের পর দিন সর্বোচ্চ টানা ৫৮ ঘণ্টা, কখনো ৪৮ ঘণ্টা, কখনো ৩৬ ঘণ্টা তাকে বাসে জার্নি করতে হয়েছে। টানা কখনো ১৫ দেশ, কখনো ১৪ দেশ তিনি ৩ মাস, ৪ মাস, ৫ মাসের জন্যে সড়কপথে এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করেছেন।
গত ২১ বছর ধরে সাগর, পাহাড়, প্রকৃতি মরুভূমি কী দেখেননি নাজমুন! এই ভ্রমণে বেরিয়ে অনেক সময়ে জীবনের ঝুঁকিতেও পড়েছেন তিনি। জানালেন, ৫ বার মৃত্যুমুখে পড়েছিলেন তিনি। তবুও বাংলাদেশের এই লাল-সবুজের পতাকাকে দেশে-দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্যে হাল ছাড়েননি।
নাজমুন বলছিলেন, 'সাহারা মরুভূমিতে মরুঝড়ে পড়েছি, রক্তাক্ত হয়েছি। পোকার কামড় খেয়েছি। অন্ধকারে আফ্রিকায় অচেনা শহরে পথ হারিয়েছি। কখনো না খেয়ে থেকেছি। কখনো কাঠ, কখনো পাথরের ওপর ঘুমিয়েছি। কখনো আদিবাসীদের সঙ্গে মাটির ঘরে ঘুমিয়েছি। কখনো রাতের অন্ধকারে বর্ডার ক্রস করতে না পেরে অপরিচিত পরিবারের সঙ্গে থাকতে হয়েছে।'
নাজমুন বলেই চলেন, '১৪ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায় পেরুর রেইনবো মাউনটেইনে অভিযাত্রায় অ্যাল্টিটিউডের সমস্যার কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। মৃত্যুকে জয় করে সেই পর্বতশৃঙ্গে উঠতে সক্ষম হয়েছি। সমুদ্রের তলদেশে স্কুবা ডাইভিংয়ের সময় পাইপ লিক হয়ে লবণাক্ত পানি খেয়েও বেঁচে ফিরেছি। পশ্চিম আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে ৩টার সময় আটকা পড়েছিলাম। সেসময় ২৬ ঘণ্টা অনাহারে থেকেছি। সবই মানসিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করেছি।'
তিনি জানান, সিয়েরালিওন থেকে লাইবেরিয়া যাওয়ার পথে ১১টি ভয়ঙ্কর কূপ পার হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, রাস্তা কোথায় ভয়ঙ্কর উঁচু, খাড়া, কোথাও পিচ্ছিল। কোথাও রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডাল সরিয়ে চলতে হয়েছিল। সবচেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন মৌরিতানিয়ায়। সেনেগালের রোজ লেকে যাওয়ার সময় ৩ ঘণ্টা জঙ্গলে হেঁটেছেন। ইথিওপিয়ার জঙ্গলে আড়াই দিন না খেয়ে থেকেছেন। পথে গাছ থেকে গাছের সাদা অরেঞ্জ খেয়ে ২ দিন পর পানির পিপাসা মিটিয়েছেন।
বাবা মারা যাওয়ার পর নাজমুন নাহার তার মা তাহেরা আমিনকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ১৪টি দেশ।
বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে বহন করতে ও বিশ্ব-শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে দেশে-বিদেশে বহু সম্মাননা ও বহু গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন নাজমুন নাহার। তার এই বিরল কাজের জন্যে তিনি পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা যুক্তরাষ্ট্রের 'পিস টর্চ বিয়ারার অ্যাওয়ার্ড' অর্জন করেছেন। এছাড়াও, দেশ-বিদেশে মোট অর্ধশত সম্মাননা পেয়েছেন। নিজের ভ্রমণে কখনো পরিবেশ রক্ষার বার্তা, কখনো পৃথিবী বাঁচানোর, কখনো যুদ্ধ নয়, শান্তি চাইসহ নানা জরুরি বার্তা দিয়েছেন তিনি।
ভবিষ্যৎ ভাবনা কী জানতে চাইলে নাজমুন বলেন, 'অনেক কষ্ট-সংগ্রাম করে বাংলাদেশের লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাকে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে পৌঁছে দিতে চাই। আমি যেখানেই যাই লাল-সবুজের ছোট্ট একটা পতাকা নিয়ে যাই। নিজেকে বাংলাদেশি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। আমি চাই পৃথিবীর সব দেশে বাংলাদেশের পতাকা পৌঁছে দিতে। বাংলাদেশকে পুরো পৃথিবী জানুক এটাই আমার উদ্দেশ্য।'
নাজমুন অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু-তরুণদের সঙ্গে তার বিশ্ব-অভিযাত্রা তুলে ধরার সময় তাদেরকে জীবনের সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তবে সেটি পৃথিবী দেখার স্বপ্ন, নিজেকে বড় করে ভাবার স্বপ্ন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একই পৃথিবীর মানুষ— সে বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।
নাজমুন নাহার বলেন, 'পৃথিবী আমাদের ঘর। এই ঘরে সব শিশু-কিশোররা বেড়ে উঠবে আপন আলোয়। আমি চাই শিশু-কিশোররা পৃথিবী দেখবে। পৃথিবী জয় করবে, শিশুরাই হবে আগামী পৃথিবীর আলো।'
নাজমুন নাহারের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো তিনি একদিন ইবনে বতুতা ও মার্কো পোলোর মতো ইতিহাসে তার পদচিহ্ন রেখে যেতে চান।
Comments