ইবাদত এরকম বোলিং আরও করবে: রামানায়েকে
বিমানবাহিনীর ভলিবল খেলোয়াড় থেকে ইবাদত হোসেন যখন পেসার হান্ট প্রতিযোগিতায় উৎরে ক্রিকেটের মূল স্রোতে আসেন, শুরুতেই তার কোচ ছিলেন চম্পাকা রামানায়েকে। শ্রীলঙ্কান সাবেক এই ক্রিকেটার এখনো বাংলাদেশের হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের পেস বোলিং পরামর্শক। ভলিবল খেলোয়াড় থেকে ইবাদতের পুরোপুরি পেস বোলার হওয়ার ধাপগুলো জানা রামানায়েকের। শুরু থেকেই ইবাদতের গতি ছিল, ছিল স্কিল। কিন্তু ছিল না ধারাবাহিকতা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখে পায়ের নিচে শক্ত ভিত পাচ্ছিলেন না তিনি। বিবর্ণ পরিসংখ্যান তার দলে থাকা নিয়েই তুলেছিল প্রশ্ন। সেই ইবাদতই এখন দেশের ইতিহাসের সেরা এক জয় পাইয়ে দেওয়ার নায়ক। তার পেসের ঝাঁজে ঘরের মাঠেই বাংলাদেশের কাছে বিধ্বস্ত হয়েছে নিউজিল্যান্ড। শিষ্যের সাফল্যে উল্লসিত রামানায়েকে দ্য ডেইলি স্টারকে শুনিয়েছেন বাংলাদেশের পেস বোলিং নিয়ে কিছু আশার গল্প।
প্রথমেই মাউন্ট মাঙ্গানুইতে ইবাদতের বোলিং নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইব। খেলা দেখেছিলেন?
চাম্পাকা রমানায়াকে: দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি খেলা দেখতে পারিনি। শ্রীলঙ্কায় এই খেলা সম্প্রচারের ব্যবস্থা ছিল না। তবে ক্রিকইনফোতে নজর রাখছিলাম সারাক্ষণ। আমি বলব ঐতিহাসিক এক স্পেল। সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয় হিসেবে সবাই এটা মনে রাখবে। ইবাদত টানা ভাল বল করেছে, তার বোলিং ফিগার সেই প্রমাণ দেয়। টেস্টের চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে এরকম বল করা কঠিন, কারণ শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়। সে তবু সাহস নিয়ে চমৎকার লাইন ও লেন্থ ঠিক রেখে গেছে। এই জিনিসটাই আমি তাকে অনেকদিন ধরে বলছি। এই ধারাবাহিকতা আনতে পারলে তার ফল আসবেই। লম্বা সময় লাগল কিন্তু অবশেষে সেটা এলো।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নদের তাদের মাটিতে হারিয়ে দেওয়া অবিস্মরণীয় ব্যাপার। সে শুরুতে ভাল পারফর্ম না করলেও তার উপর আস্থা রাখার জন্য আমি নির্বাচকদের ধন্যবাদ দিব। আমি খুবই আনন্দিত কারণ সে আমার ছাত্র। লম্বা সময় আমার সঙ্গে কাজ করেছে। শরিফুলও আমার ছাত্র। সেও ভাল বল করেছে। তাসকিন, মেহেদী (মিরাজ)ও ধারাবাহিকভাবে ভাল করেছে পুরো ম্যাচে।
প্রথম ১০ টেস্টে ইবাদত কেবল ১১ উইকেট নিয়েছিলেন। তার ৪৬ রানে ম্যাচ জয়ী ৬ উইকেট নেওয়ায় সবাই বিস্মিত। আপনিও কি তেমনটা হয়েছিলেন?
রামানায়েকে: হ্যাঁ। আসলেই এটা অবিশ্বাস্য। এবং সেটা চতুর্থ ইনিংসে। এটা খুব সহজ কাজ নয়। পেস বোলার হিসেবে জানি এটা কতটা কঠিন কারণ আপনার শরীর অনেক ক্লান্ত হয়ে যাবে। ৬ উইকেট নিয়ে এসব অবস্থায় ম্যাচ জেতানো অবিস্মরণীয় ব্যাপার। আমি মনে করি সে এখন ভীষণ আত্মবিশ্বাসী হবে কারণ এখন সে জানে সে উইকেট নিতে পারে। বিশ্বাসটা এখন আছে।
ওই ম্যাচের পর তার সঙ্গে কথা হয়েছে? আপনি তো তার শুরুর কোচ। এমন পারফরম্যান্স আসার পর নিশ্চিয়ই সংগ্রামের ধাপগুলো মনে করার কথা।
রামানায়েকে: হ্যাঁ কাল (টেস্টের পরদিন) আমার সঙ্গে কথা হয়েছে, আমরা আনন্দ ভাগ করেছি। হ্যাঁ ছাত্র হিসেবে লম্বা সময় তাকে পেয়েছি। তার স্কিল বরাবরই ছিল, কিন্তু একটানা জায়গায় বল ফেলতে পারার যে দক্ষতা সেটার ঘাটতি ছিল। আমরা এইগুলো নিয়ে কাজ করেছি। তার আত্মবিশ্বাসটা দরকার ছিল। এই টেস্টের পারফরম্যান্সে আমার মনে হয় সেটা এসেছে।
এমন ছন্দ ধরে রাখতে ইবাদতের জন্য আপনার পরামর্শ কি হবে?
রামানায়েকে: বাংলাদেশে কন্ডিশন স্পিনারদের পক্ষে থাকে। কিন্তু দেশের বাইরে উইকেট ঘাস থাকে, পেস বোলারদের জন্য সহায়তা থাকে। আপনি যদি ঠিক জায়গায় টানা বল ফেলতে পারেন, আপনার পক্ষে ফল আসবে। সেজন্য আপনাকে ধর্য্য ধরতে হবে। ইবাদত এটা করে দেখিয়েছে। এটা বিশাল কিছু। কয়েক বছরের মধ্যে সে সেরা এক বোলারে পরিণত হবে। আমি নিশ্চিত সে এরকম বোলিং আরও করবে।
ইবাদত দুই দিকেই বল মুভ করিয়েছে, রিভার্স করিয়েছে। এসব কেমন দেখলেন?
রামানায়েকে: এটা তো শিল্প। আপনি যদি লম্বা সময় ধরে এটা করতে থাকেন এটা অভ্যাসে পরিণত হবে। একাগ্র চেষ্টার ফল বলব।
বিমানবাহিনীর সৈনিক, ছিলেন ভলিবল খেলোয়াড়। ওই জায়গা থেকে তার ক্রিকেটে মানিয়ে নেওয়া, বিশেষ করে পেস বোলিংয়ের মতো কঠিন কাজে মানানোটা কীভাবে হলো। আপনি শুরুর সময়টা থেকে তো তাকে দেখছেন।
রামানায়েকে: তার ভেতরে এটা ছিল (পেস বোলিং)। সুন্দর একটা ছন্দ নিয়ে শুরু করেছিল। প্রথম যখন এলো আমি দেখলাম এরমধ্যেই সে স্কিল আয়ত্ত করে ফেলেছে। কিন্তু ধারাবাহিকতা ছিল না। এই কয়েক বছরে অনেক ক্রিকেট খেলেছে। কিছু টেস্ট ম্যাচও খেলে ফেলল। আমি জানি বেশি উইকেট নিতে না পারায় সে হতাশ ছিল। কিন্তু আমি তাকে বারবার মনে করিয়ে দিতাম ধৈর্য ধরো এবং ধারাবাহিক হও, সুদিন আসবে।
তার বোলিং অ্যাকশনটা কেমন দেখেন? খুব সহজ মনে হয়। আপনার কি মনে হয় চোটমুক্ত থেকে খেলতে এটা সহায়ক?
রামানায়েকে: খুব সহজ অ্যাকশন। বলা যায় ইনজুরি ফ্রি অ্যাকশন। এটাও সহজাত ব্যাপার। সে এমনিতে খুবই ফিট। তার অ্যাকশন তাকে লম্বা সময় ধরে খেলতে সাহায্য করবে। এটাও একটা প্রকৃতি প্রদত্ত উপহার।
টেস্টে বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিটটা কেমন দেখছেন?
রামানায়েকে: এখনো পর্যন্ত এটাই বাংলাদেশের সেরা পেস বোলিং ইউনিট। একটা সময় মাশরাফি (মর্তুজা) ছিল কিন্তু তখন সেরকম আর কেউ ছিল না তার পাশে। এখন ইবাদত, তাসকিন আছে, শরিফুল আছে, রাহি-খালেদ আছে। কাজেই ব্যাকআপও অনেক। কিন্তু এই ছেলেদের উপর আস্থা রাখতে হবে। সেজন্য আমি আগে নির্বাচকদের ধন্যবাদ দিয়েছিলাম।
একটা সময় ঘরের মাঠে পেস বোলার খেলাতে বাংলাদেশ তেমন একটা আগ্রহী ছিল না। আপনার কি মনে হয় এই ভাবনাটা বদলাচ্ছে?
রামানায়েকে: ভিন্ন কন্ডিশনে ভিন্ন ধরণের বোলার লাগবে। বাংলাদেশের ঘরের মাঠে স্পিনারদের সুবিধা থাকে, তারা সেভাবেই খেলে। আমার মনে হয় ভালো খেলোয়াড় থাকায় পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এটা নির্ভর করে দল থেকে আপনি কি চান। অবশ্যই ঘরোয়া ক্রিকেটে কিছু বদল দরকার। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট খুবই ট্যাকটিক্যাল। কিন্তু আপনি সব সময়ই ওদের (পেসারদের) দিয়ে চেষ্টা করতে পারেন। আমি বলব ওয়ানডেতে স্পোর্টিং উইকেটে বাংলাদেশের আরও পেসার খেলানো উচিত।
আগামীতে ভাল করতে পারে এমন কিছু নাম বলতে পারেন?
রামানায়েকে: যুব দল ও এইচপি দলে বেশ কয়েকজন পেসার আছে। আমি শরিফুলের সঙ্গে কাজ করেছি, সেও আমার ছাত্র। সে খুব ভাল করছে এখন। অনেক বোলার উঠে আসছে। রেজাউর রহমান রাজার কথা বলব, যার ভিত্তি খুব মজবুত। সে স্কিডি, জুতসই গতি আছে, বাউন্স করায়। তার সাম্প্রতিক পারফম্যান্সে আমি খুশি। আমি আশা করি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সে পা রাখবে এবং ভাল করবে।
সামনে আপনার পরিকল্পনা কি?
রামানায়েকে: মার্চে ফিরব বাংলাদেশ। পেস বোলারদের নিয়ে ঢাকায় একটি বিশেষ ক্যাম্প হবে। সেটি পরিচালনা করব। আমি ওই ক্যাম্পের জন্য মুখিয়ে আছি। জুন থেকে এইচপির ক্যাম্প শুরু হবে। সেখানেও কাজ করা হবে।
Comments