বৈষম্যের কারণে মাথাপিছু আয়ের তথ্যকে ‘নিষ্ঠুর রসিকতা’ ভাবছে মানুষ

'যে আয় মানুষের মাথার পেছনে থাকে, জনগণ যে আয় দেখতে পায় না, তাকে মাথাপিছু আয় বলে।'

দ্য ডেইলি স্টারের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় (সাময়িক) ৯ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার হচ্ছে, এমন সংবাদের নিচে একজন পাঠক এ মন্তব্য করেছেন।

গতকাল মঙ্গলবার মাথাপিছু আয়ের নিউজ পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য পাঠক সেখানে এ ধরনের মন্তব্য করতে থাকেন। মন্তব্যগুলো দেখে বোঝা যায়, দেশের মাথাপিছু আয় বাড়লেও তাদের আয় বাড়েনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ ধরনের পোস্টের ছড়াছড়ি দেখা গেছে।

অথচ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গতকাল একনেক বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'মানুষের কেনাকাটা অনেক বেড়েছে। গ্রামে গেলেই দেখা যায়, মানুষ কেনাকাটা করছে। তার মানে মানুষের আয় বেড়েছে। হতে পারে কারো কম বেড়েছে কিংবা কারো বেশি। তবে আয় বেড়েছে।'

তাহলে সরকার যখন দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে, তখন মানুষ কেন তার বিপরীত ভাবছে?

অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বৈষম্যের কারণে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ায় মাথাপিছু আয় বাড়লেও দেশের মানুষের প্রকৃত আয় কতটা বেড়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশের গিনি কো-ইফিশিয়েন্ট ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২, যা ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। গিনি কো-ইফিশিয়েন্ট যত বাড়বে, বৈষম্য তত বাড়ছে বলে বোঝা যাবে। বর্তমানে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য সর্বকালের সর্বোচ্চ।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাথাপিছু আয় ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে সমর্থিত নয়।'

এই প্রাসঙ্গিক তথ্য বলতে তিনি নিম্ন বেসরকারি বিনিয়োগ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন, ঋণের প্রবৃদ্ধি, কাঁচামাল আমদানিকে বুঝিয়েছেন।

এ ছাড়া সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে মারাত্মক ত্রুটি আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'দেশের আয় বৈষম্য যে বেড়েছে, সেটি খুব ভালোভাবেই সরকারের মাথাপিছু আয়ের তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে। আর এ জন্যই মানুষ মাথাপিছু আয়ের তথ্যের সঙ্গে নিজেদের মিল খুঁজে পাচ্ছেন না।'

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাথাপিছু আয় বাড়লেই সব মানুষের আয় সমানভাবে বাড়বে, বিষয়টি তেমন নয়। যেহেতু এটি গড় হিসাব করে বের করা হয়, সুতরাং কারো আয় অনেক বাড়লেও মাথাপিছু আয় বাড়তে পারে। আর সেক্ষেত্রে মানুষ এই তথ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে নাও পেতে পারেন।'

যেহেতু বৈষম্য বেড়েছে এবং সার্বিক দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, তাই অনেকের কাছে এই তথ্য তাদের নিজেদের সঙ্গে অসামঞ্জস্য মনে করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয় কমায় বৈষম্য বেড়েছে প্রায় সারা বিশ্বেই। আর দেশে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে দেশের মূল্যস্ফীতি ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছিল। মার্চে ভোক্তা মূল্য সূচক ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু মাথাপিছু আয় মানে হলো গড় আয়, সুতরাং এটি সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা দেখায় না।'

তিনি বলেন, 'যেহেতু বাংলাদেশে আয় বৈষম্য অনেক বেশি, তাই সাধারণ মানুষের আয় কমলেও মাথাপিছু আয় বাড়তে পারে।'

'যখন মানুষ পত্রিকায় দেখে মাথাপিছু আয় বেড়েছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা অনুভব করে যে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে, তখন তারা এসব তথ্যকে নিষ্ঠুর রসিকতা হিসেবেই বিবেচনা করে,' বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

Comments

The Daily Star  | English

US-China tariff war punishes Bangladesh

Bangladesh is one of those nations that face pressure from Washington to decouple their manufacturing industries from Chinese suppliers, according to officials familiar with trade negotiations.

11h ago