কাঁচামাল হিসেবে বাংলাদেশি কাপড়ের চাহিদা বাড়ছে দেশে ও বাইরে
বিশ্বের প্রধান আন্তর্জাতিক পোশাক খুচরা বিক্রেতারা কাঁচামাল হিসেবে বাংলাদেশি কাপড়ের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে কাঁচামাল সরবরাহের জন্য অপেক্ষাকৃত কম সময় নেওয়া বা কম লিড টাইম থাকা এবং পণ্য পরিবহনের খরচের ক্ষেত্রে সাশ্রয়।
ফলে স্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরাও ক্রেতাদের কাছে ৪৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন। কাঁচামাল হিসেবে দেশে তৈরি কাপড় ব্যবহারের কারণে এ সময়সীমা কমে এসেছে। আগে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও পাকিস্তান থেকে কাপড় আমদানি করার কারণে পণ্য সরবরাহ করতে ৯০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেত।
বিক্রয় মৌসুম শুরুর আগেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের দোকানগুলোতে পণ্যের মজুদ রাখার তাগিদের কারণেও বাংলাদেশে উৎপাদিত কাপড়ের দিকে ঝুঁকছে আন্তর্জাতিক খুচরো দোকান ও ব্র্যান্ডগুলো।
এর আগে ক্রেতারা বছরে ৩ মৌসুম জুড়ে পণ্য বিক্রি করতেন। এখন ফাস্ট ফ্যাশনের জনপ্রিয়তার কারণে তারা ৬ মৌসুম ধরে কাপড় বিক্রি করেন। ফাস্ট ফ্যাশন বলতে পোশাকের দ্রুত পরিবর্তনশীল নতুন ধাঁচের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ বলেন, 'কাপড় আমদানি করে ফ্যাশনের সর্বশেষ ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা খুবই ঝামেলাপ্রদ, কারণ এতে অনেক সময় লাগে।'
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আগে এইচঅ্যান্ডএম ও জারার মতো প্রখ্যাত ক্রেতারা ৩ মাসের লিড টাইমসহ পণ্য অর্ডার করতেন। এখন ফাস্ট ফ্যাশনের প্রভাবে এ সময় কমে ২ মাস হয়েছে।
'সুতরাং, ক্রেতারা এখন স্থানীয় কাপড়কে প্রাধান্য দিচ্ছেন', যোগ করেন আজাদ। তিনি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ লিড টাইম, পণ্য পরিবহনের অস্বাভাবিক খরচ ও কনটেইনারের অভাবকে ক্রেতা ও রপ্তানিকারক, উভয়ের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
মহামারির পর অর্থনীতি আবারও গতিশীল হওয়ার পর কম লিড টাইম ও কাঁচামালের সহজলভ্যতার মতো বিষয়গুলো বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
এমন কি, ২০২০ সালে মহামারি আঘাত হানার আগেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে স্থানীয় কাপড়ের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছিল।
করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার হতে শুরু করলে স্থানীয় কাপড়ের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। সময়মত পণ্য সরবরাহ করা এবং পরিবহণের খরচ কমানোর (যেটি ৫০০ শতাংশের চেয়েও বেশি বেড়ে গেছিল) উদ্দেশে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশে ব্যবহৃত কাপড়ের মূল উৎস হচ্ছে চীন। তবে চীন থেকে দেশের কারখানাগুলোতে কাপড় আনতে ৩০ দিন সময় লেগে যায়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনসুর আহমেদ বলেন, 'যদি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাপড় ব্যবহার করা হয়, তাহলে পণ্য রপ্তানি করতে সব মিলিয়ে ৪৫ দিন সময় লাগে। এ কারণে খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো স্থানীয় কাপড়ের ব্যবহার বাড়াচ্ছে।'
হামিদ ফ্যাব্রিক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ মাহিন বলেন, 'আমার হাতে সরবরাহ সক্ষমতার চেয়েও বেশি অর্ডার রয়েছে।'
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি হুগো বস, অ্যাবেরক্রোম্বি এবং ফিচ, টমি হিলফিগার, ক্যালভিন ক্লেইন, জেসি পেনি, এইচ অ্যান্ড এম, এসপ্র্রিট, এম অ্যান্ড এস, এস.অলিভার এবং বেনেটনের কালার্সের মতো বিখ্যাত বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডগুলোর জন্য ওভেন কাপড় সরবরাহ করে।
এছাড়া ৩০০ টিরও বেশি বড়, মাঝারি ও ছোট খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক পণ্য সংগ্রহ করে। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাপ, ওয়ালমার্ট, টেসকো, জি স্টার, ভিএফ এশিয়া, লি অ্যান্ড ফাং, ইউনিক্লো, জারা, ইন্ডিটেক্স, আমেরিকান ঈগল এবং এলসি ওয়াইকিকি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার প্রাক্কলিত হিসেব অনুযায়ী অনুযায়ী, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ৯৫ লাখ বেল কাপড়ের প্রয়োজন হতে পারে। ৩ বছর আগে এই চাহিদার পরিমাণ ছিল ৭০ লাখ বেল।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজীম বলেন, রপ্তানিকারকরা স্থানীয় কাপড় ব্যবহার করে পোশাক বানালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বে ৬০ দিন পর্যন্ত সময় বাঁচাতে পারেন।
'তবে এ ক্ষেত্রে দাম একটি বড় বিষয়, কারণ চীন প্রতিযোগিতামূলক দামে কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারে', যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
তিনি জানান, মিলগুলোতে অর্ডারের অভাব নেই। তবে গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় এ খাত বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি জানান, বাংলাদেশি মিলাররা চীন থেকে পিছিয়ে আছে, কারণ তারা প্রতিযোগিতামূলক দাম ও বিভিন্ন নকশার কাপড় খুব সহজেই দিতে পারে।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments