ই-কমার্স প্রতারণা

সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা বনাম আইনের অভাব

প্রতীকী ছবি | স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

ই-কমার্স খাতের জন্য আলাদা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের দরকার নেই। এই খাতে শৃঙ্খলা আনার জন্য বিদ্যমান আইনি কাঠামোই যথেষ্ট বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে বিডিজবস ডটকম ও আজকেরডিল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুরের অভিমত, ই-কমার্স সেক্টরের প্রতারণামূলক চর্চা নিবারণে পণ্য ও সেবা সম্পর্কিত অভিযোগ দায়েরের জন্য বিশেষায়িত রাষ্ট্রীয় সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিআরপি) সক্ষমতা বাড়ানো দরকার।

মাশরুর বলেন, 'ই-কমার্সের জন্য আমরা নতুন কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাই না। এ জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরও কার্যকর করা দরকার। যাতে সংস্থাটি এ সংক্রান্ত প্রবিধানগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে পারে।'

গতকাল শনিবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত 'চ্যালেঞ্জেস ইন দ্য ই-কমার্স সেক্টর: হোয়াট শুড বি ডান' শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে মাশরুর এই মন্তব্য করেন।

মাশরুর আরও বলেন, পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রিম অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহকেরা যাতে প্রতারিত না হন, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও বড় ভূমিকা আছে। কারণ সেখানে লেনদেনের রেকর্ড থাকে। যার মাধ্যমে প্রতারণার বিষয়গুলো শনাক্ত করা যেত।

'কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনাগুলো ঘটেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনেই। এ ক্ষেত্রে তাদের স্পষ্ট অবহেলা ছিল।' বলেন দেশের ই-কমার্স খাতের অন্যতম পথিকৃৎ মাশরুর।

এ ব্যাপারে তানজিব আলম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের এর প্রধান তানজিব-উল-আলমের বক্তব্য, 'এখানে সরকারি সংস্থাগুলোও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে…প্রায় প্রতি পদক্ষেপেই তারা অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।'

তানজিব মনে করেন, যদি সরকারি সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়, তাদের সততা বজায় থাকে, তাহলে ই-কমার্স খাতে এখনকার মতো টালমাটাল অবস্থা তৈরি হবে না। একই সঙ্গে তিনি বলেন, সক্ষমতা ও নেতৃত্বের দিক থেকে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি এসেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছ থেকে।

গত বছরের আগস্ট মাসে একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, ই-ভ্যালির বাণিজ্যিক মডেল প্রতারণামূলক বিনিয়োগ কার্যক্রম পঞ্জি স্কিম ও বহুস্তর বিপণন পদ্ধতির (মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং) কোম্পানির মতো। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর, মুদ্রা পাচার আইনের বিধান উল্লেখ করে বিএফআইইউ এক মাসের জন্য প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন স্থগিত করে।

তানজিবের মতে, বিএফআইইউ এই স্থগিতাদেশ বাড়িয়ে ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু তা না করায় সাধারণ মানুষ এই বিশ্বাসে উপনীত হয় যে, ই-ভ্যালির বাণিজ্যিক চর্চা ঠিক আছে। কারণ লেনদেন তদারকির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের কোনো ত্রুটি খুঁজে পায়নি।

তানজিব বলেন, 'ওই সময় আমি ভেবেছিলাম যে, ই-ভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেলকে আইনের মুখোমুখি হবেন। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে তিনি তার এই সঙ্কটকে সুযোগে পরিণত করলেন। বিএফআইইউ খুব দক্ষতার সঙ্গে তাকে এই সুযোগটি করে দেয়। আর তিনি আরও বৃহৎ কলেবরে নির্ঝঞ্ঝাট তার ব্যবসা চালিয়ে যান।

এরপর রাসেল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও র‌্যাবের চলচ্চিত্রকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে, কোম্পনির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে সেলিব্রেটিদের নিয়োগ দিয়ে ও গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ বেপরোয়াভাবে খরচ করতে শুরু করেন।

এরপর ই-ভ্যালি যখন আইসিটি বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের আইডিএ প্রকল্পের প্রতিযোগিতা বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ট-২০২১ এবং ই-কমার্স মুভার-২০২০ এর স্পন্সর হয়ে ওঠে, তখন প্রতিষ্ঠানটি আরও এগিয়ে যায়।

তানজিব-উল-আলমের মতে, এসব কিছুই কোম্পানি হিসেবে ই-ভ্যালিকে বৈধতা দেওয়ার পাশাপাশি তা সাধারণ মানুষের মনে ইতিবাচক একটা প্রভাব তৈরি করে।

এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা আইন অনুসারে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।

'কিন্তু তারা এটা করেনি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে হাজারো অভিযোগ জমা হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগের এই ধারা সামলানোর সক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটির ছিল না। ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তারা।' যোগ করেন আলম।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ই-ক্যাব অনেক প্রতিষ্ঠানের এমন ঝুঁকিপূর্ণ মডেলের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করলেও তদারককারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে তানজিব-উল-আলম বলেন, 'বাংলাদেশে আমরা যেখানেই কোনো সঙ্কটের মুখোমুখি হই না কেন, সবাই এটা বোঝানোর চেষ্টা করি যে, সঙ্কট প্রতিরোধে যথার্থ আইনের অভাব থাকার কারণেই এটা ঘটেছে।'

একইভাবে ই-কমার্স খাতের কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হওয়ার পর খাতটি নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইনের প্রস্তাব আছে।

'কিন্তু এটা এই খাতের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই নতুন আইনের দরকার নেই। কারণ এই খাতের অনিয়ম রোধ করার জন্য বিদ্যমান আইনগুলিই যথেষ্ট।'- যোগ করেন তানজিব।

ওয়েবিনারে বক্তব্য দেন অনলাইন সুপারমার্কেট চালডাল ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াসিম আলিম। যার প্রতিষ্ঠান চলমান মহামারির মধ্যেও দারুন প্রবৃদ্ধি দেখেছে। আলিম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। তিনি মনে করেন, নতুন আইন ই-কমার্সকে আরও কঠিন করে তুলবে। এর চেয়ে বিদ্যমান সরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হলে সেটা আরও কার্যকর হবে।

ওয়াসিম আলিম বলেন, 'বছরের পর বছর ধরে আমরা গ্রাহকদের আস্থা তৈরি করেছি। কিন্তু চলমান ঘটনাগুলো আমাদের ওপর আঘাত হয়ে এসেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নতুন গ্রাহক তৈরি করার ক্ষেত্রে আমরা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছি।'

এদিকে ফাহিম মাশরুরের মতে, ই-কমার্স সেক্টরে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ তারা এ ধরনের কোম্পানিগুলোকে অর্থ পরিশোধের অনুমতি দিয়েছে। অথচ ওই কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কিছুদিন ধরেই অভিযোগের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেনের অভিমত, 'সাম্প্রতিক প্রতারণামূলক ই-কমার্স কর্মকাণ্ডগুলো কিছু লোকের জন্য বিনিয়োগ প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। আর আগেই এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, এ ব্যাপারে খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। যা প্রতারকদের এই খাতে বিপর্যয় ঘটনোর সুযোগ করে দিয়েছে।

দেশে বেকারত্ব একটা বড় সমস্যা- মন্তব্য করে ফাহিম মাশরুর বলেন, 'দেশে অসংখ্য যুবক বেকার। একইসঙ্গে হতাশ। ব্যাংকের সুদের হার কম। শেয়ার বাজারও নিরাপদ নয়। তাহলে তরুণরা আয়ের জন্য যাবে কোথায়?'

স্বাভাবিকভাবেই তারা দ্রুত বর্ধনশীল ই-কমার্স খাতের দিকে আকৃষ্ট হবে।

'আপনি যদি মনে করেন যে, কেবল একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, সেটা ভুল।'- যোগ করেন মাশরুর।

এদিকে গ্রাহকের টাকা উদ্ধারের জন্য তানজিব-উল-আলম ভুক্তভোগীদের কোম্পানি আইনের ২৪১ ধারায় উচ্চ আদালতে পিটিশন দায়ের করার পরামর্শ দেন।

'এরপর আদালত একজন অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারেন। যিনি কোম্পানির দায়িত্ব নেবেন এবং অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করবেন।'

তানজিব বলেন, পরে ‍উদ্ধারকৃত অর্থ আনুপাতিক হারে ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। তিনি মনে করেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সব অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ এর একটি বড় অংশ বেপরোয়াভাবে খরচ করা হয়েছে।

এই আইনজীবীর ভাষ্য, সরকার যদি করদাতাদের অর্থ দিয়ে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেয়, তাহলে তা অসাংবিধানিক হবে। একইসঙ্গে এটি ভবিষ্যতের কেলেঙ্কারিগুলোকেও উদ্দীপ্ত করবে। মানুষের কাছে এমন একটি বার্তা যাবে যে, যা কিছুই ঘটুক না কেন, সরকার তার দায়িত্ব নেবে।

সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান ই-কমার্স খাতে প্রচুরসংখ্যক তরুণ উদ্যোক্তার সম্পৃক্ততায় নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, বিদ্যমান ঘটনাসমূহ এই খাতে উদ্যোক্তা বৃদ্ধির বিষয়টিকে বাধাগ্রস্ত করবে না।

রেহমান সোবহান বলেন, 'এটা মূলত সিস্টেমের বাইরের একটা বিষয়। এটা একটা কেলেঙ্কারি…যা বিদ্যমান সিস্টেমের ভেতর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়। আর এটা এমন কোনো কেলেঙ্কারি নয়, যা প্রথম বারের মতো ঘটেছে।'

দেশের বর্ষীয়ান ও প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেলেঙ্কারি/প্রতারণার ঘটনাগুলো উদ্ভূত হয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা থেকে। তিনি বলেন, 'এটা সুশাসন না থাকার সমস্যা। আপনি কীভাবে আইন প্রয়োগ করছেন- তার প্রশ্ন।'

রেহমান সোবহান আরও বলেন, সব বড় কেলেঙ্কারিগুলোর ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্টদের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে তাদের সুনজর পাওয়ার জন্য, সুরক্ষা পাওয়ার জন্য।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, কর্মসংস্থান তৈরি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ই-কমার্স খাতের বিপুল সম্ভাবনা আছে।

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments