গ্রাহকের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা নেই ই-ভ্যালির

গ্রাহকদের কাছ থেকে পণ্য ডেলিভারির জন্য ই-ভ্যালি যে অগ্রিম অর্থ নিয়েছে তা ফিরিয়ে দিতে পারবে না বলেই মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল তার দেওয়া এই বক্তব্যে হতাশ হয়েছেন অসাধু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটির হাজারো ক্ষুদ্ধ গ্রাহক।
ই-কমার্স খাতে সাম্প্রতিক সময়ের সমস্যাগুলো নীরিক্ষণের উদ্দেশ্যে আয়োজিত বৈঠক শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, 'আমার মনে হয় না ইভ্যালির কাছে কোনো টাকা আছে। তাদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধারের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।'
সচিবালয়ে টিপু মুনশির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ।
ইভ্যালির অভিযুক্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল চলতি সপ্তাহে তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান, ভোক্তাদের কাছে ৭০০ কোটি ও বিক্রেতাদের কাছে আরও ২৫০ কোটি টাকা দেনা আছে তার।
টিপু মুনশি বলেন, 'অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইভ্যালি তার ভোক্তাদের টাকা ফিরিয়ে দিতে পারবে না, কারণ, হয় তারা টাকা সরিয়ে ফেলেছে অথবা বেশিরভাগ অংশ বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ করে ফেলেছে। প্রতিষ্ঠানটি ক্রীড়া ও অন্যান্য অনেক অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছে।'
ইভ্যালি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিয়েছে এবং বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রম স্পন্সর করেছে। যেমন ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০২০, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিউজিল্যান্ড সফর এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের সিনেমা 'অপারেশন সুন্দরবন'-এর অর্থায়ন, ইত্যাদি।
এ ছাড়া, প্রতিষ্ঠানটি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে অভিনয় ও সংগীত শিল্পী তাহসানের মতো তারকাদের নিয়ে এসেছে।
প্ল্যাটফর্মটি ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তাদের যাত্রা শুরু করে এবং অবিশ্বাস্য রকমের মূল্য ছাড় ও আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে খুব দ্রুত মানুষের আলোচনায় আসে। মূল্য ছাড় ও বিজ্ঞাপনের পেছনে প্রচুর টাকা খরচ করেছে ইভ্যালি।
এ ধরনের খরচ জোগাতে ইভ্যালি তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে পণ্যের জন্য অগ্রীম মূল্য আদায় করে, কিন্তু তাদের অনেকেই কাঙ্ক্ষিত পণ্যের ডেলিভারি পাননি।
একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রেতাদেরকেও বড় অংকের লাভের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য সংগ্রহ করে।
সুতরাং, যত বেশিদিন ধরে ইভ্যালিকে এভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেওয়া হবে, ততই ভোক্তা ও বিক্রেতাদের প্রতি প্রতিষ্ঠানের দেনা বাড়তে থাকবে এবং আরও বেশি সংখ্যক নিরীহ মানুষ তাদের প্রতারণার জালে জড়িয়ে যাবে। সব ধরনের যুক্তি বলছে, ইভ্যালি বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ।
তবে, বাণিজ্য মন্ত্রী বলেন, 'ইভ্যালি কিংবা তাদের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যেমন ই-অরেঞ্জ বা ধামাকা শপিং-এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'বন্ধ করে দেওয়ার পরিবর্তে সরকার এই পথভ্রষ্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সুবিধাজনক সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। অসাধু ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের কারাগারে পাঠানো কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়।'
উল্লেখ্য, ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল ও চেয়ারপারসন শামীমা নাসরিন গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে পুলিশের হেফাজতে আছেন।
সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসাকে পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা নীরিক্ষণ করার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
'আমরা যদি মনে করি তারা ভোক্তা ও বিক্রেতাদের টাকা ফিরিয়ে দিতে পারবে, তাহলে আমরা তাদের বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করব', বলেন টিপু মুনশি।
তিনি জানান, যদি ইভ্যালির পরিকল্পনা সন্তোষজনক না হয়, তাহলে সরকার প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
'সরকার একটি আলাদা বোর্ড গঠন করার পরিকল্পনা করছে, যেটি পথভ্রষ্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালনা করবে। যাতে তারা ভোক্তা ও বিক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ফিরিয়ে দিতে পারে।'
টেকসই নয়, এ ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রতিরোধে এবং এই দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে সরকার ই-কমার্স খাতের জন্য একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারেও ভাবছে। একই সঙ্গে একটি ডিজিটাল বাণিজ্য আইন প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা চলছে, বলেও জানান তিনি।
টিপু মুনশি বলেন, 'প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে এগুলো (আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা) মেনে চলতে হবে।' তিনি আরও জানান, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ই-কমার্স কতৃপক্ষের পক্ষ থেকে আলাদা করে নিবন্ধন সংখ্যা দেওয়া হবে।
ভোক্তারা বড় মূল্য ছাড়ের সুযোগ নিতে গিয়ে অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছেন উল্লেখ করে টিপু মনশি বলেন, 'পণ্যের ডেলিভারি বিলম্বিত হবে জেনেও তারা বড় অংকের টাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন।'
তিনি বলেন, 'এ ধরনের বড় আকারের মূল্য ছাড়ের বিজ্ঞাপন অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য এবং ভোক্তাদের উচিৎ ছিল আরও চিন্তাভাবনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।'
তবে, ৪ জুলাই জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮-এর মানসম্মত কার্যপ্রণালী বিধি (এসওপি) চালুর পর ই-কমার্স খাতে অসাধু আচরণের ঘটনা কমে এসেছে।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, 'অসাধু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের কিছু অংশ সংশোধন করতে হবে।'
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments