অতিরিক্ত তারল্য সত্ত্বেও সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিতে অটল বাংলাদেশ ব্যাংক

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় রেকর্ড অতিরিক্ত তারল্য ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির মন্দা থাকা সত্ত্বেও গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরেও তারা সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করবে।

আগের সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি করোনাভাইরাস মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির চাহিদা বৃদ্ধিতে খুব একটা সফল হয়নি। এরপরও সংকট মোকাবিলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আবারও একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্যে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন পণ্যের চাহিদা বাড়ানোর মাধ্যমে জিডিপির কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়।

এতে আরও বলা হয়, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অতিরিক্ত তারল্য যদি আর্থিক খাতে অপ্রত্যাশিত চাপ বা বাবল তৈরি করে, তাহলে সেই টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে তুলে নেবে। প্রয়োজনে উপযুক্ত নীতি গ্রহণে দ্বিধা করবে না সংস্থাটি।

নতুন মুদ্রানীতি কৃষি, এসএমই ও রপ্তানিমুখী খাতকে উৎসাহিত করবে, যাতে চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিরসন করা যায়।

গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথাগত কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপ্রথাগত মুদ্রানীতি গ্রহণ করা শুরু করে, যা চলমান অর্থবছরেও অব্যাহত রাখা হয়েছে।

কিন্তু, বর্তমানে কোভিড-১৯ এর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে এ সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি উৎপাদনশীল খাতকে উজ্জীবিত করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

বিবৃতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, 'সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সতর্কতার সঙ্গে একটি সম্প্রসারণমূলক ও সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি তৈরি করেছি।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ অবস্থান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ব্যবসায় মন্দা ও ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে, গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জন থেকে অনেক দূরে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ হলেও, অর্জিত হয়েছে মাত্র  আট দশমিক ৪০ শতাংশ।

২০২১-২২ অর্থবছরেও ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একই রাখা হয়েছে এবং বেসরকারি খাতে এক লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ফজলে কবির বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের জন্যে কোনো কোয়ানটিটেটিভ ইজিং ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না।

কোয়ানটিটেটিভ ইজিং অপ্রচলিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের একটি বিশেষ ধরনের হাতিয়ার। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ সরবরাহ বাড়াতে এবং ঋণ ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে উন্মুক্ত বাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদি সিকিউরিটিস বা বন্ড কিনে থাকে।

তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অনুৎপাদনশীল খাতে টাকা প্রবাহে লাগাম টানার ব্যবস্থা নেবে। একইসঙ্গে উৎপাদনশীল খাতে অর্থ সরবরাহের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।

এর অংশ হিসেবে, নতুন মুদ্রানীতি কৃষি, এসএমই, রপ্তানিমুখী শিল্প ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নতুন মুদ্রানীতি মনোযোগ দেবে। মহামারির কারণে এ খাতগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সাত দশমিক দুই শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক তিন শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্যের কথাও জানিয়েছেন ফজলে কবির। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ এ দুটি প্রধান সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

নতুন নীতিটি মহামারির বিরূপ প্রভাবগুলো দূর করে মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে আশা প্রকাশ করেন গভর্নর। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থনৈতিক কার্যক্রম আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি, যা অতিরিক্ত তারল্য বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) ও পলিসি রেট কমিয়ে রাখার আগের অবস্থান অপরিবর্তিত রেখেছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সিআরআর কমিয়ে চার শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনে।

দেশের সব তফসিলি ব্যাংককে মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের (আমানতের) একটি অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে যে অংশ নগদে রাখতে হয়, তাকেই সিআরআর বলা হয়।

এ ছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক রেপোর হার ১২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে চার দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল। একইসঙ্গে রিভার্স রেপোর হার ৭৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে চার শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল।

সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক উভয়ই এখন বিভিন্ন সেক্টরকে পুনরুজ্জীবিত করতে এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। ফলে রেকর্ড পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হয়েছে, যা গত জুনে দুই  লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রসারণমূলক নীতির ফলে সৃষ্টি হওয়া সস্তা টাকার কারণে ইতোমধ্যে কিছু বুদবুদও তৈরি হয়েছে। পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে এর প্রমাণও দেখা যাচ্ছে। অতিরিক্ত তারল্যের কারণে গত কয়েক মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বেঞ্চমার্ক সূচক বেড়েছে ব্যাপকভাবে।

কবির বলেন, 'গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে যে, কিছু মহল প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় থাকা কম সুদ হারের ঋণের অপব্যবহার করছে। ‍মহামারির কারণে ব্যাংকগুলোতে পরিচালিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরেজমিন পরিদর্শন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আমরা অফ-সাইট তদারকি জোরদার করেছি।'

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে প্রণোদনা তহবিলের ঋণ বিতরণের বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে বলেছে।

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসএমই ও কৃষি খাতের ঋণ বিতরণের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

'কিন্তু, অতিরিক্ত তারল্য কীভাবে দূর করা যায়, সে বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের', তিনি উল্লেখ করেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশ তহবিল নিজস্ব উৎস থেকে বিতরণ করছে। সংস্থাটি সাধারণত রিজার্ভ মানির মাধ্যমে তহবিল সরবরাহ করায় অতিরিক্ত তারল্য নিয়মিতভাবে বাড়ছে বলে উল্লেখ করেন মনসুর।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, বর্তমান কোভিড পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, 'এখন মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার বড় কোনো ঝুঁকি নেই। কিন্তু, সরকারের উচিত খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে অধিকতর মনোযোগ দেওয়া।'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলছেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার না হলে মুদ্রানীতিটির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।

ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামের মতে, ঋণ প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য প্রত্যাহার করা উচিত হবে না।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

3,930 candidates for 44th BCS to face fresh viva: PSC

The oral interviews of these candidates were conducted up until July 18 after a total of 11,732 examinees passed the 44th BCS written tests

1h ago